বিবিসি::বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হবার পর থেকে ‘গণতন্ত্রে উত্তরণের’ সময়কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলোর ফলাফল নিয়ে পরাজিত পক্ষ সবসময় নাখোশ ছিল।
বড় দুটি রাজনৈতিক দল-বিএনপি ও আওয়ামী লীগ-যখন পরাজিত হয়েছে, তখন তারা নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই পাঁচটি নির্বাচনের পূর্বাপর ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়েছে এ লেখায়।
নির্বাচন ১৯৯১: বিএনপির জয়
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন ছিল সেটি। যদিও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সংবিধানের অংশ ছিল না, কিন্তু সবগুলো রাজনৈতিক দলের সম্মতির ভিত্তিতে সেটি করা হয়েছিল।
১৯৯১ সালে নির্বাচনের আগে প্রচারের সময় দুই প্রধান রাজনৈতিক দল পরস্পরের প্রতি খুব বেশি আক্রমণাত্মক ছিল না। তৎকালীন সংবাদপত্র পর্যালোচনা করে এ ধারণা পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দলীয় জোট এবং বামপন্থী পাঁচ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেয়। এ জোটগুলো সামরিক শাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। সে সময় নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে শেখ হাসিনা যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে তার সেই আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে।
দলের ইশতেহার ঘোষণার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করে।
আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলে যে ক্ষমতায় গেলে তারা ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্বহালের মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম করবে।
উত্তরাঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারণার সময় শেখ হাসিনা বগুড়ায় এক জনসভায় বলেন, আওয়ামী লীগ বেশি কথা বলে না, সেমি-ফাইনাল বা ফাইনাল গেমের হুমকিও দেয় না। আওয়ামী লীগ যা করতে পারে কেবল সেটাই বলে।
সংসদে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যমুনা সেতু নির্মাণসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন তিনি। নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে শেখ হাসিনার আশাবাদ বিভিন্ন জনসভায় লক্ষ্য করা যায়।
“দেশে-বিদেশে রব উঠিয়াছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাইবে,” খুলনায় এক নির্বাচনী সমাবেশে শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে এই শিরোনাম করেছিল দৈনিক ইত্তেফাক।
অন্যদিকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তার নির্বাচনী প্রচারের সময় বিভিন্ন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি যেমন দিয়েছেন, অপরদিকে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নানা ‘সতর্কবার্তা’ উচ্চারণ করেন।
দেশজুড়ে প্রচারাভিযানের শেষ পর্যায়ে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে এক সমাবেশে খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগকে টার্গেট করে বলেন, আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা, অন্যদের হাতে গোলামির জিঞ্জির।
“ বাংলাদেশকে বিদেশীদের গোলামীর চুক্তিতে আবদ্ধ করিতে না চাহিলে ধানের শীষে ভোট দিন,” খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করে লিখেছিল দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা।
এদিকে নির্বাচনে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের জন্য জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের কঠোর নির্দেশনা দেন।
নির্বাচনের আগের দিন রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবউদ্দিন আহমদ বলেন, এবারের নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে বাধ্য।
১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোট দেবার জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়।
সাড়ে ছয় কোটি ভোটারের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট পড়ে। নির্বাচনে কোথাও কোন ধরণের সহিংসতা দেখা যায়নি।
এই নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। তবে নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় কোন দল সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
এই নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ৮৪টি আসনে। এছাড়া জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসনে এবং জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসনে জয়লাভ করে
নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরপরই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অগণতান্ত্রিক শক্তি সূক্ষ্ম কারচুপি করেছে।
“ভোটাররা আমাদের ভোট দিয়েছে, কিন্তু চিহ্নিত অগণতান্ত্রিক শক্তি সূক্ষ্ম কারচুপি, কালো টাকা, সন্ত্রাস এবং এক অদৃশ্য শক্তির সাথে ষড়যন্ত্র করে ভোটের রায়ের ফল পাওয়া থেকে ভোটারদের বঞ্চিত করেছে,” শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে লিখেছিল দৈনিক সংবাদ পত্রিকা।
এ সময় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় কারণ নিয়ে দলটির তৎকালীন নেতা ড, কামাল হোসেনের একটি চিঠি ব্যাপক শোরগোল তৈরি করে।
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দেয়া এক চিঠিতে তিনি বলেন, অতি-বিশ্বাস, আত্মম্ভরিতা এবং কর্ম-বিমুখতার কারণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়েছে।
ড. হোসেন লিখেছিলেন, নির্বাচনের অনেক আগেই বিজয় সম্পর্কে তারা অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। সেজন্য নেতা-কর্মীরা নিশ্চিত বিজয়ের আগাম গর্বে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।
দীর্ঘ চিঠিতে তিনি লেখেন, এছাড়া ডানপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো আওয়ামী লীগকে ভারতের সেবাদাস এবং ধর্মের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে যেভাবে অপপ্রচার চালিয়েছে তার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের প্রচারণা বরাবরই দুর্বল ছিল।
এদিকে সরকার গঠনের জন্য বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর আলোচনা চলতে থাকে। একপর্যায়ে জামায়াতে ইসলামী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠির মাধ্যমে বিএনপিকে সমর্থন দেবার কথা জানায়।
১৯৯১ সালের ২০শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করে খালেদা জিয়া।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, বিতর্কিত নির্বাচন
১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিএনপি সরকার এক বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন করে। দেশের সবকটি বড় রাজনৈতিক দল সে নির্বাচন বয়কট করেছিল। এ প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল ১৯৯৪ সালে মাগুরা জেলার একটি উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।
তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সে উপ-নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন দাবি করে।
কিন্তু বিএনপি শুরু থেকে সে দাবি নাকচ করে আসছিল। কিন্তু দাবি আদায়ের জন্য আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে তাদের আন্দোলন জোরদার করে। আওয়ামী লীগের এই দাবিকে সমর্থন করে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী।
১৯৯৫ সালে বছর-জুড়ে বিভিন্ন সময় হরতাল এবং অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচী দেয় আওয়ামী লীগ। একদিকে বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচী জোরালো হচ্ছিল অন্যদিকে বিএনপি সরকারও একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিএনপি যুক্তি দিয়েছিল, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতেই হবে।
দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার জন্য নানা কূটনীতিকের আলোচনা ও মধ্যস্থতার চেষ্টা বিফলে যায়। বিরোধী দলগুলোর তীব্র আন্দোলন ও বয়কটের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনের দিন বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় অন্তত ১০ জনের নিহত হবার খবর প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে।
একতরফা সেই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। নির্বাচনে পর তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি একেএম সাদেক সাংবাদিকদের বলেন, কত শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে সেটি বড় কথা নয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেটাই আসল কথা।
৩০০ আসনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৫০টি আসনে। ৪৬টি আসনে একাধিক প্রার্থী না থাকায় বিএনপির প্রার্থীরা ভোটের আগেই নির্বাচিত হয়ে যান।
নির্বাচন ১৯৯৬
আসন সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে জোরালো লড়াই হয়েছিল ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৪৬ টি আসন এবং বিএনপি পেয়েছিল ১১৬টি আসন।
এছাড়া জাতীয় পার্টি ৩২টি এবং জামায়াতে ইসলামী তিনটি আসনে জয়লাভ করেছিল।
সরকার গঠন করার জন্য কোন দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে ২১ বছর পরে ক্ষমতার মঞ্চে ফিরে আসে দলটি।
১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পরও বিরোধী দলগুলোর জোরালো আন্দোলন অব্যাহত থাকে। তবে নির্বাচনের পর থেকে ধারণা যাওয়া যাচ্ছিল যে শীঘ্রই আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
কূটনীতিকদের সমঝোতা চেষ্টা এবং তীব্র চাপের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালের ৩রা মার্চ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে বলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য সংসদে বিল আনা হবে।
তিনি বিরোধী দলকে আলোচনার জন্য আহবান জানান। এর দুইদিন পরে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
১৯৯৬ সালের ১৯ শে মার্চ বাংলাদেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম যে অধিবেশন শুরু হয়, তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা। অধিবেশনের চতুর্থ কার্যদিবস অর্থাৎ ২৪শে মার্চ রাতে জাতীয় সংসদে সংবিধানে যুক্ত করার জন্য বাছাই কমিটির রিপোর্টসহ বিলটি উত্থাপন করা হয়। ২৬ শে মার্চ ভোররাতে বহুল আলোচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল সংসদে পাশ হয়।
কারণ, বিরোধী দলগুলোর সন্দেহ ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ করলেও বিএনপি হয়তো সহজে ক্ষমতা ছাড়বে না।
সেজন্য বিরোধী দলগুলো তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেনি।
এক পর্যায়ে ১৯৯৬ সালের ৩০ শে মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন এবং ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তৎকালীন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
নির্বাচনী ইশতেহারে শেখ হাসিনা বলেন, ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিবেশী ভারতের সাথে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি সম্পাদন করা হবে। এছাড়া ভারতের সাথে ১৯৭২ সালে সম্পাদিত মৈত্রী চুক্তি নবায়ন করা হবে না বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দেশ ও জাতিকে সেবা করার সুযোগ দিন।”
নির্বাচনের প্রস্তুতি ও প্রচারণা যখন চলছিল, তখন ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত আরেকটি ঘটনা। তৎকালীন সেনাপ্রধান আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করেন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস। জেনারেল নাসিমের বিরুদ্ধে ‘সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অভিযোগ আনা হয়। অন্যদিকে জেনারেল নাসিমও বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রাষ্ট্রপতি তাকে যেভাবে অবসর প্রদান করেছেন সেটি ‘অবৈধ’।
নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পরপরই সবগুলো আসনের ফলাফল প্রকাশিত হয়নি।
প্রথম দিকে ২৭১ টি আসনের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ১৩৩টি আসন, বিএনপি ১০৪টি আসন, জাতীয় পার্টি ২৯টি আসন এবং জামায়াতে ইসলামী ২ টি আসন। এছাড়া ২৭টি আসনের ১২৩টি কেন্দ্রে পুননির্বাচন হয়েছিল।
এজন্য সরকার গঠন করতে আওয়ামী লীগের প্রয়োজন ছিল জাতীয় পার্টির সমর্থন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর বিএনপির তরফ থেকে ফলাফল মেনে নেয়া হয়নি। দলটির তৎকালীন মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদার এক সংবাদ সম্মেলনে ১১১টি আসনে পুনরায় নির্বাচন দাবি করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সদস্য একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ইতিহাসের নজিরবিহীন কারচুপি করা হয়েছে। এ কারচুপি পূর্বপরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক।
এর একদিন পরেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিএনপি নির্বাচনের ফল গ্রহণ কিংবা বর্জন কোনটাই করেনি। তবে দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা পূরণে নানাভাবে বাধা দেয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
কিন্তু আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিল যে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে। যারা এ মতামত দিয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল – যুক্তরাষ্ট্রের এনডিআই, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সার্ক ও জাপান পর্যবেক্ষক গ্রুপ।
এনডিআই বলেছিলেন, নির্বাচনের কারচুপির যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে সে সংক্রান্ত প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেনি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা জানান, নির্বাচনে ৭৩ শতাংশ ভোট পড়েছে এবং নির্বাচনে কারচুপির কোন সুযোগ ছিল না।
জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ১৯৯৬ সালের ২৩ শে জুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা।
সংসদে যোগদানের প্রশ্নেও বিএনপির মধ্যে অনাগ্রহ এবং দ্বিধা কাজ করছিল। শেষ পর্যন্ত বিএনপি সংসদে যোগ দেবার কথা ঘোষণা করে। অনেকে ধারণা করেন, এর পেছনে আন্তর্জাতিক চাপ কাজ করেছিল।
নির্বাচন ২০০১ : বিএনপির ব্যাপক বিজয়
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নানা কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘটনাবহুল অধ্যায়। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী জোটবদ্ধ হয়ে এই নির্বাচনে অংশ নেয়।
ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করে সংবিধান অনুসারে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আওয়ামী লীগ সরকার। তখন প্রধান উপদেষ্টা পদে আসীন হন তৎকালীন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান।
প্রধান উপদেষ্টার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো একটি নির্বাচিত সরকার হিসেবে ৫ বছর মেয়াদ শেষ করে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করতে পেরে আমি আনন্দিত।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণের কয়েক-ঘণ্টার মধ্যে প্রশাসনে বড় ধরণের রদবদল করেন লতিফুর রহমান। প্রধান উপদেষ্টার আদেশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিসহ ১৩জন সচিবকে একসাথে সরিয়ে দেয়া হয়। এনিয়ে ব্যাপক আলোচনার তৈরি হয় সে সময়। বিষয়টি বিএনপি ইতিবাচকভাবে দেখলেও আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি।
বিএনপির তরফ থেকে দাবি তোলা হয় যাতে নির্বাচনের আগে দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে হবে।
সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া বলেন, “দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হবো। আর সেটি না হলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত।”
এক পর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুলিশের মাধ্যমে বিশেষ অভিযান শুরু করে। সারা দেশকে ৬৮টি সেক্টরকে ভাগ করে এ অভিযান শুরু করা হয়েছিল।
নির্বাচনের প্রচার চালানোর সময় শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপি যা বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাই করে।
২০০১ সালের ১লা অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোট দেবার সময় শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া – দুজনেই আশা করেন তাদের দল নির্বাচনে জয়লাভ করবে।
ভোট দেবার সময় শেখ হাসিনা বলেন, “ ২শ’ আসন পাবার আশা নিয়ে কাজ করেছি, তবে ১৮০ থেকে ১৯০ আসন পাব ইনশাল্লাহ।”
অন্যদিকে খালেদা জিয়া বলেন, কারচুপি না হলে চারদল দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হবে।
নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, স্থূল কারচুপি করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। জনগণ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে, আমার মেনে নেয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
নির্বাচনের পরে নতুন আরেক পরিস্থিতির তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হিন্দুদের উপর হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এবং লুটপাটের অভিযোগ আসতে থাকে। এসব ঘটনার সাথে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা জড়িত বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। তখনো বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদায় কাল।
এমন অবস্থায় ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপিয়ান কমিশনের রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
কিন্তু বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণের পরেও পরিস্থিতির কোন বদল হয়নি।
সংসদের যোগ না দেবার ব্যাপারে বেশ অনড় ছিলেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে দৈনিক সংবাদ পত্রিকা লিখেছিল – চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে গেছে, এখন আমাদের সংসদে যাওয়া না যাওয়ায় কিছু আসে না। তিনি বলেন, কারচুপির নির্বাচন বাতিল এবং জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম চলবে।
নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগ সারাদেশে আধাবেলা অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দেয়। এছাড়াও তারা আরো কিছু কর্মসূচী ঘোষণা করে।
লতিফুর রহমান যখন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তখন আওয়ামী লীগ তার সমালোচনায় মুখর। এমন অবস্থায় লতিফুর রহমান জাতির উদ্দেশে তার বিদায়ী ভাষণে দাবি করেন, দায়িত্ব পালনকালে তার সরকার কারো পক্ষে বা বিপক্ষে কোন কাজ করেনি।
আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করলেও, সাথে সাথে সংসদে যোগ দেবার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের ‘সন্ত্রাসীরা’ সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের হত্যা করছে। অত্যাচার, নির্যাতন, বাড়িঘর লুটপাটের অভিযোগও তোলেন তিনি।
নানা রাজনৈতিক বাদানুবাদের পরে এক সময় আওয়ামী লীগ সংসদে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়।
নির্বাচন ২০০৮ : আওয়ামী লীগের ফিরে আসা
পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশে সর্বশেষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর যাবত একটানা ক্ষমতায় রয়েছে।
২০০১ সালে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে সংবিধানে একটি বড় সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। অভিযোগ রয়েছে, নিজেদের পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে রেখে নির্বাচনের সময় সুবিধা আদায়ের জন্য এই কাজ করেছিল বিএনপি সরকার।
এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। জারি করা হয় জরুরী অবস্থা।
জরুরী অবস্থা জারি করার অন্তত ছয় মাস আগে থেকে ঢাকার নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার বিষয়ে বহু বৈঠক করেছেন। সংঘাত এড়িয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধান করার ওপর জোর দিয়েছিলেন তারা।
কূটনৈতিকদের মধ্যে তখন সবচেয়ে বেশি তৎপর দেখা গিয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পেট্রেসিয়া বিউটেনিসকে।
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত মিস্ বিউটেনিস ওয়াশিংটনে যে গোপন তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন সেটি ফাঁস হয়ে হয়ে যায় উইকিলিস-এর ওয়েবসাইটে।
২০০৭ সালের ৯ই জানুয়ারি পাঠানো এক তারবার্তায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার ২০০৭ সালের ৭ই জানুয়ারি খালেদা জিয়ার সাথে একটি বৈঠক করেন।
সে বৈঠকে দুই কূটনীতিক রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নেবার আহবান জানান। তারা খালেদা জিয়াকে আরো বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা হলে দেশ সংঘাতের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে এবং সামরিক হস্তক্ষেপের যে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে সেটিও দূর হবে।
ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও কার্যত সেটি পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী।
ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে সরকার আভাস দিয়েছিল যে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
সেজন্য কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ছবি সহ ভোটার তালিকা তৈরি।
একই সাথে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় তথাকথিত দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মূল লক্ষ্য ছিল রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ উঠেছিল আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতির বাইরে রাখার জন্য সর্বাত্নক চেষ্টা করেছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সেটি সফল হয়নি।
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ – উভয় দলকে ভেঙ্গে টুকরো করতে চেয়েছিল তৎকালীন সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয়নি।
মূল নেতৃত্বের বাইরে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে আরেকটি অংশ সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছিল, যারা `সংস্কারপন্থী` হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের মধ্যে বিষয়টা খুব বেশি প্রকাশ্যে না আসলেও বিএনপি `সংস্কারপন্থী` অংশটি প্রকাশ্যে এসেছিল। তারা দলের ভেতরে নানা ধরণের সংস্কার প্রস্তাব সামনে এনেছিল।
পরবর্তীতে সবদলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নানা সমঝোতার চেষ্টা চলে। পর্দার সামনে এবং আড়ালে বিএনপি-আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা এবং সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সেটি নিয়ে ২০০৮ সালের গোড়া থেকেই সন্দেহ শুরু হয়। নির্বাচনে অংশ নেবার বিষয়ে খালেদা জিয়ার কিছু আপত্তি ছিল। তিনি চেয়েছিলেন তার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানের মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কিন্তু সেনা গোয়েন্দারা শর্ত দেন যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে খালেদা জিয়ার শর্ত মেনে নেয়া হবে।
বিএনপির তৎকালীন নেতা মওদুদ আহমদের ভাষ্য এবং তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের ফাঁস হয়ে যাওয়া গোপন তারবার্তা থেকে এসব কথা জানা যায়।
এই নিয়ে খালেদা জিয়ার সাথে সেনা কর্মকর্তাদের তীব্র দরকষাকষি চলে দীর্ঘ সময়। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়।
তবে খালেদা জিয়ার সাথে সরকারের কী ধরণের সমঝোতা হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিএনপির নেতারাও জানেন না বলে মনে হয়েছে।
`বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্যা আফটারম্যাথ (২০০৭-২০০৮)` শিরোনামের বইতে মওদুদ আহমদ অনুমান করেছেন যে ছেলেদের মুক্তি এবং বিদেশ পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়া হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।
নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রার্থী বাছাই, জোটের শরীকদের সাথে আসন ভাগাভাগি, নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন -এসব কিছুর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে বেশ গোছানো মনে হয়েছে বিএনপির তুলনায়।
তখন বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারনায় শেখ হাসিনা তুলে ধরেন ভবিষ্যতে তিনি বাংলাদেশকে কীভাবে দেখতে চান। আওয়ামী লীগের “ডিজিটাল বাংলাদেশ” শ্লোগান তরুন ভোটারদের আকৃষ্ট করে। এছাড়া দুর্নীতি দমন এবং বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করার কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন ইশতেহারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার করা।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি নিয়ে ২০০৬ সাল থেকে জোরালো তৎপরতা শুরু করে সেক্টর কর্মান্ডার্স ফোরাম। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় এনিয়ে জনমত গঠনের জন্য কাজ করতে থাকে।
এমন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের নির্বাচন ইশতেহারে বিষয়টি অন্তভূর্ক্ত হয়।
২০০৮ সালের ১০ই নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি গোপন এক তারবার্তায় লিখেছেন, ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য তিনি প্রস্তুতি শুরু করেছেন।
নির্বাচনের দিন বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মানুষ ভোট কেন্দ্রে হাজির হয়েছিল। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের সামনে ছিল ভোটারদের দীর্ঘ সারি। যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, সেজন্য ভোটকেন্দ্রগুলোতে কোন রাজনৈতিক প্রভাব চোখে পড়েনি।
নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী ২০০৮ সালের সাধারন নির্বাচনে ৮৬.২৯ শতাংশ ভোট পড়েছে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩০টি আসন। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছিল মাত্র ৩০টি আসন। শুধু তাই নয়, প্রাপ্ত ভোটের হারের ক্ষেত্রে ছিল বিশাল ফারাক। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৮.১৩ শতাংশ ভোট এবং বিএনপি পেয়েছিল ৩২.৪৯ শতাংশ ভোট।
সে নির্বাচনে দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভরাডুবি হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর। চারদলীয় জোটের শরীক হিসেবে ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র দুটি আসনে জয়লাভ করেছিল দলটি। এছাড়া ভোট পেয়েছিল ৪.৬০ শতাংশ।
২৯ শে ডিসেম্বর রাতেই মোটোমুটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করতে যাচ্ছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন তার বইতে লিখেছেন, “আমরা এমন রেজাল্ট আশা করিনি। আমাদের প্রাথমিক ধারণা ছিল যে মহাজোটের সাথে চারদলীয় জোটের তফাৎটা হয়তো ৪০ থেকে ৫০টি আসনের হতে পারে।”
নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পারেনি বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলা হয়।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগে তখন উল্লাস আর উচ্ছ্বাস। নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আত্নবিশ্বাসী ছিল ঠিকই, কিন্তু জয়ের ব্যবধান এতো বেশি হবে সেটি অনেকে ভাবতে পারেননি।
Leave a Reply