পাইকগাছা ( খুলনা )::”বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে আসা ৩৫ প্রতিবন্ধীকে হুইল চেয়ারসহ বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দিলেন খুলনার পাইকগাছার লস্কর ইউনিয়নের প্রতিবন্ধীদের একমাত্র আশ্রয়স্থল পাইকগাছা লস্করের সর্বপ্রথম অক্সিজেন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বারবার নির্বাচিত মানবিক চেয়ারম্যান কে এম আরিফুজ্জামান তুহিন।
গত ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস থাকলেও জাতীয় সাংসদ নির্বাচনের কারনে অনুষ্ঠান পিছিয়ে রবিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে কাগুজী প্রতিবন্ধী কল্যান ট্রাষ্টের আয়োজনে লক্ষীখোলা কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে অধ্যক্ষ কে এম মেছবাহুল ইসলামের সভাপতিত্বে হুইল চেয়ার ও অন্যান্ন সামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন,উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা অনাথ কুমার বিশ্বাস, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সমিরন কুমার সাধু, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সম্পাদক আনন্দ মোহন বিশ্বাস, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান লিপিকা ঢালী, ইউপি চেয়ারম্যান কওসার আলী জোয়াদ্দার, যুবলীগ নেতা অহিদুজ্জামান মোড়ল, প্রভাষক আব্দুল ওহাব বাবলুসহ দলীয় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এ উপস্থিত ছিলেন।
২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে নানাবাড়ি থেকে বাড়ি ফেরার পথে পাইকগাছার চাঁদখালী ইউনিয়নের গজালিয়া এলাকায় দেখতে পান, এক মা তাঁর তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ুয়া প্রতিবন্ধী মেয়ে তাসলিমাকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, প্রতিদিন প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের স্কুল থেকে আবার নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর ওই মেয়েকে একটি হুইল চেয়ার কিনে দেন আরিফুজ্জামান। তাঁর লেখাপড়ার দায়িত্বও নেন তিনি। সেই থেকে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আরিফুজ্জামানের পথচলা শুরু। তাসলিমা খাতুন এখন পাইকগাছা সরকারি কলেজে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়েন।
এখন তিনি তাঁর এলাকার আশপাশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতা করেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার খরচ বহন করা, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, হুইল চেয়ারসহ সহায়ক উপকরণ দেওয়া, ঘর বানিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করছেন তিনি নিজের টাকায়। ১৮ বছর ধরে প্রতিবন্ধীদের সেবা করে যাচ্ছেন। এখন তাঁর তথ্যভান্ডারে ২৮৫ জনের মতো প্রতিবন্ধীর নাম রয়েছে, যাঁদের তিনি নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। প্রতিবন্ধীদের পরম বন্ধু এই মানুষটির নাম কে এম মো. আরিফুজ্জামান। সবাই তাঁকে তুহিন কাগজী নামে চেনেন। পেশায় তিনি ঘের ব্যবসায়ী। বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়নের লক্ষীখোলা গ্রামে। লস্কর ইউনিয়ন পরিষদের টানা তিনবারের চেয়ারম্যান তিনি।
সম্প্রতি কথা হয় তাসলিমার সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর বাবা দিনমজুর ছিলেন। এখন অসুস্থ থাকায় কাজ করতে পারেন না। তাসলিমা বলেন, ‘জন্ম থেকেই দুই পা অচল, হাঁটতে পারি না। ছোটবেলায় অন্যদের স্কুলে যেতে দেখে আমাকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার বায়না ধরেছিলাম। তখন বাড়ির আশপাশের অনেকেই আমার মা-বাবাকে নিষেধ করেছিলেন আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে। পরে দেখা যায়, আমি স্কুলে প্রথম হয়েছি। তুহিন কাকুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এঘন সব খরচ তিনিই বহন করেন। তিনি না থাকলে এতদূর আসা হতোনা।
আরও ১৫-১৬ জনের পড়ার খরচ দেন আরিফুজ্জামান। এ ছাড়া ১০ জন প্রতিবন্ধীকে ঘর বানিয়ে দিয়েছেন, হুইলচেয়ার দিয়েছেন ২৮৫ জনকে, শ্রবণযন্ত্র দিয়েছেন প্রায় ৬০ জনকে, পড়াশোনার খরচ দিচ্ছেন ১৬ জনকে, বছরে বই-খাতা কিনে দেন ৩০ জনকে, পানি জন্য টেংকি দিয়েছেন ১৫টি, পনির ফিলটার ৫০ জনকে, স্কুল কলেজে ভর্তি করেছেন ৪০ জনকে, সারা বছরের খাওয়ার জন্য খোরাকি দেন ১৫ প্রতিবন্ধীকে, থাকার জন্য খাট দিয়েছেন ৫টি, টিউবওয়েল দিয়েছেন ৫টি, কম্পিউটার কিনে দিয়েছেন ২টি, দোকানসহ মালামাল কিনে দিয়েছেন ৩জনের, তিনজনকে কৃত্রিম পা বানিয়ে দিয়েছেন এই জনপ্রতিনিধি। তাঁর কাজের বিস্তৃতি পাইকগাছা উপজেলাসহ খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলায়।
রবি সানা ও রনি সানার বাড়ি উপজেলার সোলাদানা গ্রামে। প্রতিবন্ধী তারা দুই ভাই এবার এসেছেন বই উপহার নিতে। রবি পড়ে পাইকগাছা সরকারী কলেজে আর রনি নবম শ্রেনীর ফাস্ট বয়। প্রতিবন্ধকতা তাদেরকে আটকাতে পারেনি। চেয়ারম্যান তুহিন তাদের লেখা পড়ার সকল খরচ দেন নিয়োমিত।
খায়রুল ইসলামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামে। খুলনা বিএল কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় দিন দিন চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন, বাড়িতেই থাকতেন। বছরখানেক আগে তাঁকে একটি কম্পিউটার কিনে দিয়ে গোয়ালডাঙ্গা বাজারে দোকান করে দেন আরিফুজ্জামান। এখন সেই দোকান থেকে আয় করেই সংসারের খরচ মেটান খায়রুল।
এক প্রশ্নের জবাবে আরিফুজ্জামান বলেন, তাঁর ও তাঁর পরিবারের মালিকানায় প্রায় ৩০০ বিঘা মাছের ঘের আছে। পাইকগাছা বাজারে একটি মাছের আড়ত রয়েছে। এসব থেকে যে আয় আসে, তার একটা অংশ দিয়ে প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করেন তিনি।
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে আরিফুজ্জামানকে। অনেকেই তাঁকে ‘পাগল’ বলেও সম্বোধন করতেন। কিন্তু দমে যাননি তিনি। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নিজস্ব জোগান বানিয়েছেন-‘প্রতিবন্ধীরা প্রতিভাবন্দী নয়, ওরাও মানুষ’। গড়ে তুলেছেন ‘কাগজী প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্ট’।
কে এম আরিফুজ্জামান তুহিন দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, যেদিন কোনো প্রতিবন্ধীর সহায়তায় কাজ করতে পারি, সেদিন রাতেই সবচেয়ে ভালো ঘুম হয়। প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করতে পারাটাই আমার নেশা।’
Leave a Reply