রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে মুমিনের দুয়ারে হাজির পবিত্র মাহে রমজান। সোমবার পশ্চিম আকাশে উদিত হয়েছে ১৪৪৫ হিজরির রমজান মাসের চাঁদ। তারাবি ও সেহরির মাধ্যমে শুরু হয়েছে রোজার আনুষ্ঠানিকতা। পবিত্র এই মাসকে স্বাগত জানিয়েছে গোটা মুসলিম উম্মাহ।
চন্দ্র বর্ষের সেরা মাস রমজান। কারণ এই মাসে মহান আল্লাহ তায়ালা অফুরন্ত রহমত ও শান্তির বারিধারা বর্ষণ করেন। তাঁর নেয়ামতের বিশাল ভান্ডার খুলে দেন। অগণিত বান্দাকে মাফ করে দেন। মুক্তির সুসংবাদ পৌঁছে দেন মুমিনের দুয়ারে দুয়ারে। সিয়াম সাধনা মানুষকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করে। এই মাস মুক্তি ও সফলতা লাভের অনন্য সুযোগ এনে দেয়।
রোজার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের বহুমুখী কল্যাণের সন্ধান দেন। মানুষের গতিপথ বিভ্রান্ত করার জন্য অভিশপ্ত শয়তান সারাক্ষণ চেষ্টা করছে। তবে রমজানের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শয়তানকে বন্দি করা হয়। শয়তানের কুমন্ত্রণা দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। রমজানে মানবতার প্রত্যাশিত ঠিকানা জান্নাতের দুয়ার খুলে দেওয়া হয়। আর অভিশপ্ত জাহান্নামের দুয়ার বন্ধ করে দেওয়া হয়। যারা জীবনের স্রোতধারা সঠিক পথে প্রবাহিত করতে চান, তাদের জন্য রমজানের চেয়ে আশীর্বাদ আর কিছু হতে পারে না।
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, এই মাসের নফল কাজগুলো ফরজের মর্যাদা পায়, আর ফরজ কাজগুলো সত্তর গুণ অধিক মর্যাদা পায় (বায়হাকি)। রমজান মাস এলে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, সৎ পথে চলার পথ সহজ হয়ে যায়, শয়তানকে শিকলে আবদ্ধ করা হয় (বুখারি ও মুসলিম)। অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে রোজা ঢালস্বরূপ। যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখবে তাঁর অতীত ও বর্তমানের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে বলে হাদিসে উল্লেখ আছে।
রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত মহান আল্লাহর বিশেষ রহমতে পরিপূর্ণ। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আর এটি এমন একটি মাস, যার প্রথম ভাগে আল্লাহর রহমত, মধ্যভাগে গোনাহের মাগফেরাত এবং শেষ ভাগে দোজখের আগুন থেকে মুক্তিলাভ রয়েছে (মিশকাত)।’ এসব সুসংবাদ কেবল তাদের জন্যই, যারা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রমজানের পূর্ণ একটি মাস রোজা পালন করেন, নিজেদের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখেন। রোজাদার ব্যক্তিরাই দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম।
রোজা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ইবাদত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তাঁর নিজের জন্য, কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব (বুখারি শরিফ)। রোজার দ্বারা খোদাভীতির যে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা হয় তা অন্য কোনো ইবাদতে সম্ভব নয়।
রোজাদারকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন। তবে রোজার দ্বারা আল্লাহর সান্নিধ্য ও কৃপা তখনই লাভ করা সম্ভব হবে, যখন রোজা হবে নিখাদ; একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত। রোজার প্রতিটি মুহূর্ত যখন আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী পালিত হবে, তখনই এর পূর্ণ ফয়েজ ও বরকত লাভে ধন্য হওয়ার আশা করা যাবে। এ জন্য রোজাদারকে সার্বক্ষণিক লক্ষ্য রাখতে হবে আল্লাহর নির্দেশনার দিকে। শরিয়তের বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে প্রতিটি ধাপে।
রোজা বা সাওম অর্থ
‘সাওম’ অর্থ বিরত থাকা; এর বহুবচন হলো ‘সিয়াম’। ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলায় সাওমকে ‘রোজা’ বলা হয়। ইসলামি পরিভাষায় সাওম বা রোজা হলো সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্তÍ ইবাদতের উদ্দেশ্যে পানাহার ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত থাকা।
আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ রাত্রির কৃষ্ণরেখা হতে উষার শুভ্ররেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়। অতঃপর নিশাগম পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)।
রোজা পালন ফরজ ইবাদত
প্রাপ্তবয়স্ক তথা সাবালক, সাধারণ বুদ্ধিমত্তা বা স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন, রোজা পালনে সক্ষম সুস্থ সব নারী ও পুরুষের জন্য রমজান মাসে রোজা পালন করা বাধ্যতামূলক বা ফরজ ইবাদত। ঋতুমতী নারী, সন্তান প্রসবকারী মা, অসুস্থ ব্যক্তিরা এই রোজা পরবর্তী সময়ে কাজা আদায় করবেন।
এমন অক্ষম ব্যক্তি, যাঁদের আবার সুস্থ হয়ে রোজা পালনের সামর্থ্য লাভের সম্ভাবনা বিদ্যমান নেই, তাঁরা রোজার জন্য ফিদিয়া প্রদান করবেন। অর্থাৎ প্রতিটি রোজার জন্য একটি সদকাতুল ফিতরের সমান দান করবেন। জাকাত গ্রহণের উপযুক্তদেরই এই ফিদিয়া প্রদান করা যাবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জান্নাতে রায়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন শুধু রোজাদারেরাই প্রবেশ করবে। তাদের প্রবেশের পরে এই দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। তারা ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি, খ-: ৩, হাদিস: ১,৭৭৫)।
রমজান মাসে ফরজ ও ওয়াজিব
রমজান মাসে একটি ফরজ, পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করা। রমজানের সঙ্গে সম্পৃক্ত দুটি ওয়াজিব, যথা: সদকাতুল ফিতর প্রদান করা এবং ঈদের নামাজ আদায় করা। রমজানের বিশেষ সুন্নাতগুলো হলো রজব মাস ও শাবান মাস বরকতের জন্য এবং রমজানপ্রাপ্তির জন্য দোয়া করতে থাকা;
রজব ও শাবান মাস থেকে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা, রজব ও শাবান মাসে অধিক পরিমাণে নফল রোজা রাখা ও নফল নামাজ আদায় করা, শাবান মাসের চাঁদের তারিখের হিসাব রাখা; রমজানের চাঁদ দেখা; সাহ্রি খাওয়া, তাহাজ্জত নামাজ আদায় করা, ইফতার করা ও করানো, ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজ আদায় করা, কোরআন কারিম বেশি বেশি তিলাওয়াত করা এবং ইতিকাফ করা; রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোয় শবে কদর সন্ধান করা এবং ঈদের জন্য শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা।
তারাবিহ নামাজ
তারাবিহ নামাজ রমজানের বিশেষ আমল। পুরুষদের তারাবিহ নামাজ মসজিদে জামাতে আদায় করা সুন্নাত। ওজরের কারণে মসজিদে যাওয়া সম্ভবপর না হলে এবং জামাত করা না গেলে তখন একা পড়লেও পূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে। অনুরূপ পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজও বিশেষ অবস্থায় একাকী আদায় করা যাবে। এতেও পরিপূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে। লেখক- সাংবাদকি ও কলামিস্ট।
Leave a Reply