আন্তর্জাতিক ডেস্ক:: দীর্ঘদিনের উত্তেজনাপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্কের পর অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নতুন এক বাণিজ্য সমঝোতায় পৌঁছেছেন। এতে দুই দেশের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ অন্তত আগামী এক বছরের জন্য স্থগিত থাকছে।
বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানের গিমহে বিমানঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দুই নেতা হাতে হাত রেখে এক বছরের বাণিজ্য যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এটি তাদের ২০১৯ সালের পর প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ।
চুক্তি অনুযায়ী, চীন তার পরিকল্পিত দুর্লভ খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এক বছরের জন্য স্থগিত রাখবে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে।
ট্রাম্প আরও জানান, চীন যদি ফেন্টানিল নামের কৃত্রিম মাদকদ্রব্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে, তাহলে তিনি ফেন্টানিল সম্পর্কিত ২০ শতাংশ শুল্ক অর্ধেকে নামিয়ে ১০ শতাংশ করবেন।
আমি বিশ্বাস করি, প্রেসিডেন্ট সি সত্যিই কঠোর পরিশ্রম করবেন যাতে এই প্রাণঘাতী মাদকের মৃত্যুযাত্রা থামে, সাংবাদিকদের বলেন ট্রাম্প, দক্ষিণ কোরিয়া ত্যাগের আগে এয়ার ফোর্স ওয়ানে উঠে।
তিনি বৈঠকটিকে অসাধারণ ও ফলপ্রসূ বলে বর্ণনা করে জানান, দুর্লভ খনিজ সংক্রান্ত সমস্যা ‘সমাধান’ হয়েছে, এবং চুক্তিটি প্রতি বছর পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।
রেয়ার আর্থ নিয়ে আর কোনো বাধা থাকবে না। অন্তত কিছুদিনের জন্য এটি আমাদের অভিধান থেকে মুছে যাবে বলেন জানান ট্রাম্প।
বৈঠকের পর চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দুই দেশের মধ্যে সমস্যা সমাধানের জন্য যৌথ ঐকমত্যে পৌঁছেছেন।
তিনি বলেন, ওয়াশিংটন ও বেইজিংকে দ্রুত এই ঐকমত্য বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে দুই দেশের জনগণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতি আশ্বস্ত হয়।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও নিশ্চিত করেছে যে, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ স্থগিতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের তালিকা সম্প্রসারণ এবং নতুন বন্দর শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা স্থগিত করেছে।
যদিও চুক্তিটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে স্বস্তির বার্তা দিয়েছে, তবুও এশিয়ার শেয়ারবাজারে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। হংকং, সাংহাই ও সিডনির সূচক সামান্য নিম্নমুখী এবং জাপানের প্রধান সূচক প্রায় অপরিবর্তিত থেকে বন্ধ হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সমঝোতা বাণিজ্য যুদ্ধের স্থায়ী সমাধান নয়, বরং সাময়িক বিরতি ও সীমিত শিথিলতা।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা ডেনিস ওয়াইল্ডার বলেন, উভয় পক্ষ এখনো তাদের ‘বাণিজ্য অস্ত্র’ নামায়নি। কেবল আপাতত গুলি চালানো বন্ধ রেখেছে।
দুর্লভ খনিজ বা রেয়ার আর্থ পণ্যে চীনের প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এগুলো ব্যবহার হয় স্মার্টফোন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান পর্যন্ত নানা আধুনিক প্রযুক্তিতে। তাই চীনের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে শিল্পক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল।
শাংহাই ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হুতং রিসার্চের অংশীদার শান গুও বলেন, ফেন্টানিল শুল্ক হ্রাস চীনের প্রত্যাশিত ফলাফল। চীনের বিনিময়ে রেয়ার আর্থকে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
তিনি আরও বলেন, যদিও যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ শুল্ক প্রত্যাহার করেনি, তবে এই হ্রাসে চীনা পণ্যের প্রতিযোগিতায় সুবিধা বাড়বে, বিশেষ করে আসিয়ান দেশগুলোর তুলনায়।
নতুন সমঝোতার পরও যুক্তরাষ্ট্রের গড়ে চীনা পণ্যে শুল্ক ৪৭ শতাংশের কাছাকাছি এবং চীনের মার্কিন পণ্যে শুল্ক প্রায় ৩২ শতাংশে রয়ে গেছে।
এছাড়া, মার্কিন কালো তালিকায় এখনো হাজারেরও বেশি চীনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এবং চীনের অবিশ্বস্ত সংস্থা তালিকায় ও অনেক মার্কিন কোম্পানি অন্তর্ভুক্ত।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক হিনরিখ ফাউন্ডেশনের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ডেবোরা এলমস বলেন, এটি পূর্ণ সমাধান নয়; বরং এক ধরনের ‘আংশিক স্থবিরতা’ বা ‘ছোট পরিসরে পিছু হটা।
অন্যদিকে, শাংহাইয়ের টাইডালওয়েভ সলিউশনস–এর অংশীদার ক্যামেরন জনসন মনে করেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি উভয় পক্ষের জন্যই সম্ভবত সর্বোত্তম ফলাফল। বার্ষিক পর্যালোচনার ব্যবস্থা থাকায় ভবিষ্যতে উভয় দেশ নিজেদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এক বছরের বাণিজ্য যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছে। চীন দুর্লভ খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ স্থগিত রাখবে, যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক ও কালো তালিকা সম্প্রসারণ বন্ধ করবে।
ফেন্টানিল শুল্ক ২০% থেকে কমে ১০% হচ্ছে। এশীয় বাজারে তেমন প্রভাব না পড়লেও বৈশ্বিক উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি সাময়িক শান্তি, স্থায়ী সমাধান নয়।