নিজস্ব প্রতিবেদক:: রাজধানী ঢাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি দীর্ঘদিনের বিষয় হলেও সাম্প্রতিক সমীক্ষা নতুন করে আতঙ্ক বাড়িয়েছে নগরবাসীর মধ্যে। বি
ভিন্ন সংস্থার যৌথ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকাজুড়ে প্রায় ২১ লাখ ৪৬ হাজার ভবনকে এখন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অধিকাংশ ভবন নির্মিত হয়েছে নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে, দুর্বল ভিত্তির ওপর বা সেকেলে নকশায়।
নগর বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ভবনগুলোর জরিপে উঠে এসেছে, বহু ভবনই ২০ থেকে ৩০ বছর আগের নির্মিত। রড-সিমেন্টের মান নিয়ন্ত্রণের অভাব, অনুমোদিত নকশার বাইরে অতিরিক্ত তলা নির্মাণ এবং সংকীর্ণ গলিতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে উচ্চ ভবন নির্মাণ এসব কারণে সামান্য কম্পনেও অনেক ভবন দুর্বল হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ ভূমিকম্প কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশটি অবস্থান করছে সক্রিয় ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলের ওপর। ভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মা প্লেটের সংঘর্ষের চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ছে দেশের উত্তর-পূর্ব দিকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় রাজধানীতে বড় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার অভিযান চালানো হবে কঠিন। পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, মিরপুরসহ অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণের এলাকাগুলোতে ক্ষয়ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানায়, শুক্রবারের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৫। কেন্দ্রস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদীতে, প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে।
ভূমিকম্পে নরসিংদী সদর ও ১০০ শয্যা হাসপাতালের তথ্যানুসারে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬০ জন ব্যক্তি আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। গুরুতর আহত দুইজনকে ঢামেকে পাঠানো হয়েছে। ওমর নামে এক শিশু আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে।
এ ছাড়া পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাবস্টেশনে আগুন লাগে; ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
ভূমিকম্প চলাকালে আতঙ্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের চারতলা থেকে লাফিয়ে একজন গুরুতর আহত হন। পাশাপাশি জিয়া হল, ফজলুল হক হল ও কবি জসিম উদ্দিন হল থেকে আরও তিন শিক্ষার্থী লাফিয়ে আহত হয়েছেন এদের একজনের পা ও একজনের কোমর ভেঙে গেছে বলে জানা যায়।
পুরান ঢাকার বংশাল এলাকায় পাঁচতলা একটি ভবনের রেলিং ধসে তিন পথচারী নিহত হয়েছেন। নিহতদের একজন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম।
শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভবনে ফাটল ও হেলে পড়ার ঘটনা ঘটেছে, যা ভবনগুলোর দুর্বল অবস্থার প্রমাণ দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, “রাজধানীর অনেক জায়গাতেই ভবন নির্মাণের উপযোগী মাটি নেই। তবুও অনুমোদন ছাড়া হাইরাইজ ভবন গড়ে উঠেছে। ভূমিকম্প সহনশীল নকশা, সেফটি জোন, ফাঁকা জায়গা কিছুই ঠিকভাবে মানা হয়নি। সংকীর্ণ গলি ও গ্যাস-বিদ্যুতের তারজালের কারণে বড় অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনাও থাকে।”
তিনি দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত, সংস্কার ও কঠোর মনিটরিং চালুর দাবি জানান।
রাজউকের ২০১৬ সালের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী রাজধানীতে অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে ৩২১টি। এর মধ্যে, সূত্রাপুরে ১৪৬টি, কোতোয়ালি ১২৬টি ও লালবাগে ২৮টি। অন্যান্য এলাকা (মোহাম্মদপুর, ডেমরা, মিরপুর, রমনা, তেজগাঁও, মতিঝিল, ধানমন্ডি) ২১টি।
তবে ২০১৬ সালের পর থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসংক্রান্ত কোনো হালনাগাদ তথ্য রাজউক প্রকাশ করেনি।
গবেষণায় দেখা গেছে, মধুপুর ফল্টে ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। প্রায় ১০০ বছরের ব্যবধানে বড় ভূমিকম্প ঘটে থাকে। সে হিসেবে বাংলাদেশ এখন বড় ভূমিকম্পের সম্ভাব্য সময়সীমায় রয়েছে।
সিডিএমপি ও জাইকার যৌথ জরিপ বলছে, ঢাকায় ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে অন্তত ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে আরও ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন। সৃষ্ট হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ।