স্পোর্টস ডেস্ক:: মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সবুজ গ্যালারি আজ যেন বাংলাদেশের টেস্ট ঘরানার দৃঢ়তা ও ধৈর্যের আরেকবার সাক্ষী হলো। পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচের শেষ দুপুরে হাসান মুরাদের করা সেই একটি বল যখন ম্যাথু হামফ্রিসের স্টাম্প ভেঙে দিল, তখন শুধু একটি উইকেট বা বিজয়ের শেষ মুহূর্তই ধরা পড়েনি একটি পূর্ণ সিরিজে বাংলাদেশের কর্তৃত্বের সিলমোহরও যেন সেখানে প্রতিফলিত হলো।
২১৭ রানের এই জয়ে বাংলাদেশ শুধু ম্যাচই জিতল না, পুরো সিরিজই ২-০ ব্যবধানে নিজেদের করে নিল।
টেস্ট ক্রিকেটে প্রায়ই দেখা যায়-ম্যাচের রঙ বদলে দিতে শেষ দিনের সকালটি যথেষ্ট। এবারও সেটি ঘটতে পারত। আয়ারল্যান্ড দিনের শুরু করেছিল ৬ উইকেটে ১৭৬ রান নিয়ে। বাংলাদেশের জয়ের হিসাব ছিল খুব সহজ: যত দ্রুত সম্ভব শেষ চার উইকেট তুলে নেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দিনের প্রথম সেশনের বড় অংশজুড়ে আয়ারল্যান্ড বাংলাদেশকে আটকে রাখল, আর সেই প্রতিরোধের সামনে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম-কার্টিস ক্যাম্ফার।
ক্যাম্ফারের ২৫৯ বল খেলে অপরাজিত ৭১ রানের ইনিংস ছিল ইস্পাত-দৃঢ় মনোবলের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ব্যাট হাতে তিনি শুধু সময় কাটাননি, দলের তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়েছিলেন একের পর এক ছোট কিন্তু বিরক্তিকর জুটি যা বাংলাদেশকে বেশ কিছুক্ষণ ভাবনায় ফেলে দেয়।
হোয়ে, ম্যাকব্রাইন কিংবা জর্ডান নিল সবাইকে নিয়ে তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন টেস্ট ক্রিকেটের মৌল নামতা মেনেই। হোয়ে তো তুলে নিলেন ১০৪ বল খেলা ৩৪ রানের এক মূল্যবান ইনিংসও।
মিরপুরে কোনো সফরকারী দলের চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বেশি বল খেলা ও সর্বোচ্চ রান করা এই দুটি রেকর্ডই এদিন নতুনভাবে লেখা হলো আয়ারল্যান্ডের নামে। এর আগে এমন দীর্ঘ প্রতিরোধ দেখাতে পারেনি মিরপুরে আগত কোনো বিদেশি দল।
বাংলাদেশি স্পিনারদের দিন ছিল এটি। আগের দিন সাকিব আল হাসানকে ছাড়িয়ে দেশের টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হওয়া তাইজুল ইসলাম আজও ছিলেন তাঁর মতো গাম্ভীর্যশীল। ম্যাচের সকালে ম্যাকব্রাইনকে এলবিডব্লিউ করে এনে দেন গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকথ্রু এটিই ছিল তাঁর ২৫০তম টেস্ট উইকেট।
অন্যদিকে মেহেদী হাসান মিরাজ আঘাত হানেন নিলের ওপর-যিনি ৩০ রান করে আয়ারল্যান্ডের আশা কিছুটা টিকিয়ে রেখেছিলেন। সবশেষে এসে মঞ্চ সাজানো ছিল হাসান মুরাদের জন্য। তার বাঁহাতি স্পিনে হোয়ে ফিরে গেলে আয়ারল্যান্ডের প্রতিরোধ আর টিকেনি। প্রথম বলেই হামফ্রিসকে বোল্ড করে ম্যাচের শেষ বিন্দুটিও তিনি ছুঁয়ে দিলেন।
এই টেস্টে মুরাদের অর্জন ৪ উইকেট; তাইজুল পেলেন ৮ উইকেট যা ম্যাচের গতিপথে সবচেয়ে বড় নিয়ামক।
জয়ের পেছনে বড় ভূমিকা আছে দুই ইনিংস মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের দৃঢ়তায়।
প্রথম ইনিংসে ৪৭৬ রানের পাহাড় গড়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় বাংলাদেশই।
মুমিনুল হকের ৮৭, সাদমানের শান্ত ৭৮ ও মাহমুদুল হাসানের ৬০ রানের ইনিংস দলকে স্থিতি এনে দেয়।
দ্বিতীয় ইনিংসে ২৯৭/৪ ডিক্লেয়ার করে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা নিশ্চিত করেন, আয়ারল্যান্ডের সামনে দাঁড়াবে চতুর্থ ইনিংসের দুরূহ পাহাড়।
মুশফিকুর রহিমের নামটি আলাদাভাবে না বললেই নয়। নিজের ১০০তম টেস্টে অভিজ্ঞতা আর দায়িত্ববোধের অনন্য মিশেলে তিনি খেলেছেন গুরুত্বপূর্ণ ৫৩ রানের অপরাজিত ইনিংস যা তাঁকে নিয়েছে ম্যাচসেরার মঞ্চে।
শেষ দিনের প্রথম দেড় সেশন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে স্বাগতিক শিবিরে উত্তেজনা ছিল স্পষ্ট। ক্যাম্ফার হোয়ে জুটি তখন বলের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল একের পর এক মাইলফলক। মাঝে একসময় মনে হচ্ছিল ম্যাচ হয়তো ড্রয়ের দিকে বেঁকে বসে। এমন ম্যাচে ড্র মানে প্রায় পরাজয়ই; কারণ পুরো ম্যাচ জুড়ে এগিয়ে থেকেও পয়েন্ট ভাগাভাগি করা হতাশাজনকই।
কিন্তু সেখানেই স্পিন ত্রয়ী তাইজুল, মিরাজ ও মুরাদ মিলে বাংলাদেশকে এনে দেন কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি। হোয়ের বিদায়ের পর আর ফিরে দাঁড়াতে পারেনি আয়ারল্যান্ড। প্রথম সেশন পেরিয়ে হঠাৎই ম্যাচ গড়িয়ে যায় স্রেফ কয়েক বলের ব্যবধানে বাংলাদেশি উল্লাসময় সমাপ্তিতে।
শেষ মুহূর্তে লিটন দাসের ক্যাম্ফারকে পিঠ চাপড়ে দেওয়া কিংবা মুশফিকের আন্তরিক শুভেচ্ছাবার্তা এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য। প্রতিপক্ষের দুর্দান্ত লড়াইকে যেমন সম্মান জানানো হয়েছে, তেমনি নিজেদের সাফল্যের আনন্দও বাংলাদেশ দল উদযাপন করেছে মর্যাদার সঙ্গে।
নাজমুল হোসেন শান্ত ট্রফি হাতে যখন সতীর্থদের সঙ্গে উদযাপন করছিলেন, তখন বোঝা যাচ্ছিল এই সিরিজ জয় শুধু সংখ্যার হিসেবে বড় কিছু নয়; বরং টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করার একটি অব্যক্ত অঙ্গীকারও এতে রয়েছে।
বাংলাদেশ: ৪৭৬ ও ২৯৭/৪ ডিক্লেয়ার, আয়ারল্যান্ড: ২৬৫ ও ২৯১, ফল: বাংলাদেশ জয়ী ২১৭ রানে, সিরিজ: বাংলাদেশ ২–০, ম্যাচসেরা: মুশফিকুর রহিম, সিরিজসেরা: তাইজুল ইসলাম।