ডেস্ক:: রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রায় তিন বছর পূর্ণ হতে চললেও শান্তির আলোচনার দৃশ্যমান অগ্রগতি এতদিন খুব কমই ছিল। তবে পরিস্থিতি এবার নতুন দিকে মোড় নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে রুশ প্রতিনিধিদল ও ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা প্রধানের মধ্যে গোপন বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে। এই বৈঠককে চলমান যুদ্ধের সম্ভাব্য সমাপ্তির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, স্থানীয় সময় সোমবার রাতেই আবুধাবিতে পৌঁছান যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সচিব ড্যান ড্রিসকল। তার আগমন ও বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে বৈঠকের বিষয়ে সন্দেহ জাগে। পরে জানা যায়, রুশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় অংশ নিতে তিনি সেখানে গিয়েছেন। আজ মঙ্গলবারও আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার পর সেনা সচিব ড্যান ড্রিসকল ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিইউআর প্রধান কিরিলো বুদানভের সঙ্গে আলাদা বৈঠকে বসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও তিন পক্ষ একসঙ্গে নাকি আলাদাভাবে বৈঠক করছে তা এখনও পরিষ্কার নয়।
এর আগে জেনেভায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনায় বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছিল এমন ইঙ্গিত মেলে। ওই আলোচনার ধারাবাহিকতায় এবং যুদ্ধ সমাপ্তির সম্ভাব্য কাঠামো নির্ধারণেই আবুধাবির এই গোপন বৈঠক বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা।
যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ২৮ দফা শান্তি প্রস্তাবকে ঘিরে হঠাৎ করেই নড়েচড়ে বসেছে সব পক্ষ। গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনের তরফ থেকে প্রস্তাবটি ইউক্রেনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় নেতাদের নিয়ে জেনেভায় আরেক দফা বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, প্রস্তাবিত নীতিমালায় 'উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি' হয়েছে। যদিও তার ভাষ্য অনুযায়ী, এখনও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাধান বাকি আছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জেনেভা আলোচনার পর বলেন, এখন এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দল আমাদের কথা গুরুত্বসহকারে শুনছে।' কিন্তু তার সঙ্গেই তিনি সতর্ক করে দেন যে, ইউক্রেন সামনে 'খুব কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি' হতে পারে। একদিকে মর্যাদা রক্ষা, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অংশীদার হারানোর ঝুঁকি এই দুই বাস্তবতার মাঝে দেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।
ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্ররা প্রস্তাবের বেশ কিছু ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে ইতিবাচক। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রস্তাবটি আলোচনার জন্য “একটি ভিত্তি” হিসেবে গ্রহণযোগ্য। বিশ্ব কূটনীতিতে রাশিয়ার এমন অবস্থান পরিবর্তনকে অনেকেই উল্লেখযোগ্য বলছেন, কারণ এ পর্যন্ত মস্কো বিভিন্ন পশ্চিমা প্রস্তাবকে সরাসরি বাতিল করে আসছিল।
অবশ্য প্রস্তাবের কোন ধারাগুলো নিয়ে রাশিয়ার সন্তুষ্টি অথবা অসন্তুষ্টি তা খোলাসা করা হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, অঞ্চলগত দখল, নিষেধাজ্ঞা শিথিলকরণ, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং যুদ্ধবিরতির পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়ন এসব বিষয়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক আলোচনাগুলো যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তির নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। তবে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আলোচনার নতুন পরিসর তৈরি হয়েছে এটিই বড় অগ্রগতি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও রাশিয়া তিন পক্ষের সমান্তরাল যোগাযোগ ইঙ্গিত দেয় যে চলমান সংঘাত সমাধানে সকলে আরও বাস্তবমুখী উদ্যোগ নিতে আগ্রহী।
তবে ইউক্রেনের শর্ত রাশিয়ার দখলকৃত ভূখণ্ড সম্পূর্ণ ফেরত দিতে হবে এখনও অটল। অপরদিকে রাশিয়া দখল করা চারটি এলাকা নিজেদের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে ফেলেছে। ফলে এই দুই অবস্থানের মাঝে সমঝোতার পথ কীভাবে তৈরি হবে, তা এখনো অস্পষ্ট।
জাতির উদ্দেশে সাম্প্রতিক ভাষণে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন, তার দেশ এমন এক কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়েছে যেখানে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে মর্যাদা হারানোর ঝুঁকি' এবং প্রধান মিত্র হারানোর আশঙ্কা দুটোর সঙ্গেই লড়তে হচ্ছে। এ বক্তব্যে অনেকেই মনে করছেন, শান্তিচুক্তির সম্ভাব্য কাঠামোতে কিছু আপস থাকতে পারে, যা ইউক্রেনীয় জনমতকে বিভক্ত করতে পারে।
যুদ্ধের দুই প্রধান পক্ষকে পরোক্ষভাবে একটি টেবিলে আনতে যুক্তরাষ্ট্র যে সক্ষম হয়েছে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় বার্তা। আবুধাবির বৈঠক সরাসরি যুদ্ধের গতিপথ বদলে দেবে কিনা তা সময়ই বলবে। তবে অন্তত এটুকু নিশ্চিত, চলমান যুদ্ধের কূটনৈতিক সমাধানের পথে যাত্রা শুরু হয়েছে