নির্জন জলছবি জীবন স্রোতের বাঁকে,
ক্ষণজন্মা আয়ূ যাপনের ছবি আঁকে।
"নির্জন জলছবি" — নামটিই যেন এক নিঃশব্দ নদীর মতো ধীরে বয়ে যায়, কিন্তু ভেতরে বহন করে গভীর স্রোত। এই কবিতার বইটি মূলত আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি ইসমাম জাহান'র এক সংবেদনশীল ও অন্তর্মুখী যাত্রার আলোক মশাল বলা যায়।
নির্জন জলছবি : এক একাকী স্রোতের শব্দ...
ইসমাম জাহানের “নির্জন জলছবি” কবিতাগ্রন্থে নীরবতা, জল, একাকিত্ব এবং স্মৃতির মধ্যে অদ্ভুত এক মেলবন্ধন তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তার নিজের মতো করে, যেমন করে পল্লীবালা নকশিকাঁথা বুনে আপন মনে বাহারি সুতায় সোনামুখি সুঁই দিয়ে। তিনি যেন শত কোলাহলে মধ্যে সময়ের নীরব কণ্ঠস্বর—যে নিজের ভেতরের জলে ডুব দিয়ে খুঁজে ফেরেন মানুষের ভাঙা আয়না, সময়ের কাঁপন, ভালোবাসার অচল রূপ, দ্রোহের আগুনের ধোঁয়া, সুখের শোক বার্তা আর মিলন যাত্রার বিরহ।
জলের প্রতীক ও নির্জনতার নন্দন...
বইটির শিরোনামই মূলত প্রতিকী। “নির্জন” মানে শুধু একা থাকা নয়—বরং নিজের আত্মার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া। আর “জলছবি” মানে প্রতিফলন, অনিশ্চয়তা, নড়াচড়া। ফলে নামেই আছে দ্বৈততা—নিশ্চুপ অথচ জীবন্ত। কবি যেমন বলতে চেয়েছেন :
“কোথাও-বা কোনো ব্যর্থ মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
সময়ের কোলাহল আমায় ডাকে—
আমি কি তবে সময়েরই এক টুকরো শব্দ?”
এই আক্ষেপের চেতনা থেকেই ইসমাম জাহান'র কবিতায় বারবার ফিরে আসে— জল, ছায়া, আয়না, হাহাকার, সময় ও নীরবতার প্রতীক।
ভাষা ও ছন্দের নির্মাণশৈলী...
ইসমাম জাহান'র কবিতার ভাষা মৃদু, কিন্তু প্রগাঢ়। তিনি চমকপ্রদ শব্দ নয়, বরং শব্দের নরম ভাঁজে অনুভবকে লুকিয়ে রাখেন, যেমন পাকা তালের আঁশে তালের রস, স্বাদ, নির্যাস আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে। অনেক কবিতায় তিনি গদ্যছন্দ ব্যবহার করেছেন, যেন কথোপকথনের ভেতরেই কবিতা জন্ম নেয়। তার ছন্দের তাল, কথার অলংকার পাঠককে শোনাবে না, অনুভব করাবে। যেমনটা তার ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় :
"শরতের কুয়াশায় ঢেকে যায় চারপাশ,
তবু ল্যাম্পপোস্টের মতো একাকিত্ব
রাতের অন্ধকারে জ্বলতে থাকে; তোমার অপেক্ষায়।"
মানুষ ও সময়ের ভাঙা সম্পর্ক...
“নির্জন জলছবি”-র কবিতাগুলোতে আমরা দেখি এক কবি সময়ের ভেতর দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করছেন নিজের অস্তিত্বকে। তার কবিতা প্রেম, বেদনা, আত্মসংলাপ ও নিঃসঙ্গতার এক কাব্যিক দলিল। একটি কবিতায় তিনি লেখেন—
“জানো, অপেক্ষা কখনও ফুরায় না,
শুধু তার রং বদলায়।”
অথবা "এক নিশ্বাসে রেখে যায় দীর্ঘশ্বাসের দাগ।"
এই এক বাক্যেই যেন বইটির সমগ্র আত্মা ধরা আছে।
অন্তর্আত্মার সুধা ও প্রেম : মায়ার ছায়ায় আত্মসংলাপ...
ইসমাম জাহান প্রেমকে রোমান্টিক ফুলের তোড়া করে দেখাননি। বরং তিনি প্রেমে খুঁজেছেন অভ্যন্তরের শূন্যতা, বিচ্ছিন্নতা ও অনিশ্চয়তা। প্রেম এখানে মায়া, আবার মুক্তিও। লেখার মাধ্যমে তার ভিতরের মুন্সিয়ানাকে তুলে ধরেছেন বা ধরার চেষ্টা করেছেন নিজের অজান্তেই। যেমন :
"ভোরের ধূসর আলো, বিকেলের কমলা, রাতের নীলচে দীর্ঘশ্বাস—
সব মিলে এক অদ্ভুত রং, যা শুধু প্রতীক্ষারই হতে পারে।"
আরেক জায়গায় লিখেছেন,
"তুমি আসবে না জানি, তবু প্রতিটি রাতের নির্জনতায়
তোমার না-বলা কথারা ফিরে আসে;
তবে কেন এই অপেক্ষার দহন?
দরজাটা খোলা থাক—
যদি কখনও পথ হারিয়ে ফিরে আসো,
আমার অভিমানী পৃথিবীর দরজার ওপারে!"