বিশেষ প্রতিবেদক:: ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য শহীদ শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে। সর্বশেষ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, হত্যাকাণ্ডের পর প্রধান অভিযুক্তদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালাতে সহায়তা করেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গসংগঠনের প্রভাবশালী নেতা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ স্বজন। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ ও তাঁর সহযোগী আলমগীর শেখকে অবৈধভাবে সীমান্ত পার করার পুরো প্রক্রিয়াটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল। এই পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মিরপুর এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে বাপ্পী। তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাঁর ভগ্নিপতি আমিনুল ইসলাম, যিনি বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে।
ডিবি পুলিশ জানায়, ফয়সাল ও আলমগীরকে আত্মগোপনে সহায়তার অভিযোগে আমিনুল ইসলামকে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালত তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন। এ নিয়ে এই মামলায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ও র্যাব যৌথভাবে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু খুনিরাই নয়, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা সেটিও বের করে আনার লক্ষ্যেই কাজ চলছে। প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ, কলরেকর্ড ও আর্থিক লেনদেন খতিয়ে দেখে পলাতক সহায়তাকারীদের একটি নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
পুলিশের তদন্তে জানা যায়, হত্যার দিন রাতেই ফয়সাল ও আলমগীর রাজধানী ছাড়েন। তারা কয়েক দফা যানবাহন পরিবর্তন করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্তে পৌঁছান। এই সীমান্ত এলাকা দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ পারাপারের জন্য পরিচিত। স্থানীয় দালালদের সহায়তায় রাতের আঁধারে সীমান্ত পার হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
এই কাজে ব্যবহৃত দালালের নাম ফিলিপ স্নাল। তাঁর বাড়ি হালুয়াঘাট সীমান্তসংলগ্ন একটি গ্রামে। তদন্ত সূত্র জানায়, ঘটনার পরপরই তাইজুল ইসলাম ভারতে অবস্থানরত অবস্থায় ফিলিপের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। যোগাযোগে ব্যর্থ হলে তিনি তাঁর ভগ্নিপতি আমিনুলকে ফোন করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেন।
আমিনুল এরপর ফিলিপের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে জানান, দুই ব্যক্তিকে ওই রাতেই সীমান্ত পার করতে হবে। পরে নির্দেশ অনুযায়ী ফিলিপকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৫ হাজার টাকা পাঠানো হয়। এর পরই ফয়সাল ও আলমগীরকে সীমান্ত পার করানো হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর গোয়েন্দা পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ফয়সাল ও আলমগীরের গতিবিধি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এতে দেখা যায়, ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা হালুয়াঘাট সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান করছিল। পরে সেখানে অভিযান চালিয়ে ফিলিপের দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, দুই ব্যক্তিকে পার করে দেওয়ার পর টেলিভিশনের সংবাদ দেখে তারা বুঝতে পারেন, ওই ব্যক্তিরা রাজধানীতে সংঘটিত একটি বড় হত্যাকাণ্ডে জড়িত। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ফিলিপ দ্রুত আত্মগোপনে চলে যায়।
এই সূত্র ধরেই পুলিশ মিরপুরে বসবাসরত আমিনুল ইসলামের সঙ্গে ফিলিপ ও তাইজুলের যোগাযোগের প্রমাণ পায়। কললিস্ট ও আর্থিক লেনদেন বিশ্লেষণ করে তাঁর সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হওয়ার পরই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক কাউন্সিলর তাইজুল ইসলাম চৌধুরী মিরপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ঢাকা উত্তর সিটির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন এবং একটি সংসদীয় এলাকার সাবেক এমপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া ফয়সাল করিম মাসুদ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন এবং তাঁর সহযোগী আলমগীর শেখ আদাবর থানা যুবলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত।
গ্রেপ্তার আমিনুল ইসলামের স্ত্রী নাজমা জানান, তাঁর স্বামী আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ছয় মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি মোবাইল ফোন কেনাবেচার ব্যবসায় যুক্ত হন। কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়ে পরিবার কোনো স্পষ্ট ধারণা পায়নি বলে দাবি করেন তিনি।
তবে পুলিশ বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমিনুলের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁর ব্যবহৃত একাধিক মোবাইল ফোন ও কলরেকর্ড বিশ্লেষণ করে হত্যাকাণ্ডের পরপরই সীমান্ত পারাপার সংক্রান্ত যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে।
গত ১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর পুরানা পল্টনের কালভার্ট রোডে রিকশায় থাকা অবস্থায় শরিফ ওসমান হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হলেও ১৮ ডিসেম্বর তিনি সেখানে মারা যান।
রোববার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে লাখো মানুষের অংশগ্রহণে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিস্থলের কাছেই দাফন করা হয়।
ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। রাজনৈতিক পরিচয় বা প্রভাব কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলেও তারা আশ্বাস দিয়েছেন।
হাদি হত্যাকাণ্ড শুধু একটি ব্যক্তি হত্যার ঘটনা নয় বরং এটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর উদ্বেগ ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে, এই অপরাধের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত।