বিশেষ প্রতিনিধি:: দীর্ঘ প্রায় ১৯ বছর পর বাবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করলেন বিএনপির চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিনই এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকা ও সাভারে তৈরি হয় আবেগঘন ও ঐতিহাসিক পরিবেশ।
শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে গুলশানে অবস্থিত নিজ বাসভবন থেকে সরাসরি রাজধানীর জিয়া উদ্যানের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে যান তারেক রহমান। সেখানে তিনি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে বাবার রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন।
বিএনপি সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সর্বশেষ বাবার কবর জিয়ারত করেছিলেন তারেক রহমান। সে সময় তিনি বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্বে ছিলেন। এরপর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংকট, মামলা, নির্বাসন ও অনুপস্থিতির কারণে আর দেশে আসা সম্ভব হয়নি তার। ফলে প্রায় দুই দশক পর এই কবর জিয়ারত বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে এক আবেগঘন অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
জিয়া মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তারেক রহমান লাল-সবুজ রঙের বুলেটপ্রুফ বাসে করে সাভারের উদ্দেশে রওনা হন। সেখানে তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। কর্মসূচিকে ঘিরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কসহ আশপাশের এলাকায় ছিল নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জিয়া উদ্যান, সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পয়েন্টগুলোতে মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্য। পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও দায়িত্ব পালন করেন। স্মৃতিসৌধ এলাকাকে ঘিরে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়।
ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরাফাতুল ইসলাম জানান, তারেক রহমানের আগমন ও শ্রদ্ধা নিবেদন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বিঘ্ন না ঘটে, সে জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।
সাভার গণপূর্ত বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন খান জানান, বিএনপির চেয়ারম্যানের শ্রদ্ধা নিবেদন উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় পরিচ্ছন্নতা, সাজসজ্জা ও সার্বিক প্রস্তুতির কাজ আগেই সম্পন্ন করা হয়েছে।
এদিকে তারেক রহমানের আগমনকে ঘিরে সাভারে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী দলে দলে সাভারে জড়ো হতে শুরু করেছেন। অনেক নেতাকর্মী শুক্রবার থেকেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও স্মৃতিসৌধসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেন।
দলীয় সূত্র জানায়, জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষের সমাগমের প্রস্তুতি রয়েছে। বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা কর্মীদের শৃঙ্খলার সঙ্গে কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে গত ২৫ ডিসেম্বর দীর্ঘ ১৭ বছর পর লন্ডন থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন তারেক রহমান। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও এলাকায় অগণিত মানুষের ঢল নামে তাকে একনজর দেখার জন্য। জনসমাগমে কার্যত জনসমুদ্রে পরিণত হয় রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো।
অভ্যর্থনার এক পর্যায়ে আবেগঘন কণ্ঠে তারেক রহমান বলেন, তিনি এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চান যেখানে বৈষম্য থাকবে না, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই নিরাপদ থাকবে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে।
তার বক্তব্যে উঠে আসে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও নিরাপদ বাংলাদেশের স্বপ্ন। তিনি বলেন, জনগণের ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই হবে তার রাজনীতির মূল লক্ষ্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাবার কবর জিয়ারত ও জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন এই দুটি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তারেক রহমান একদিকে পারিবারিক আবেগের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় ইতিহাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি শক্ত রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন।
দলীয় নেতারা মনে করছেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরা ও ধারাবাহিক কর্মসূচি বিএনপির রাজনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করবে। দীর্ঘদিন ধরে হতাশায় থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে এটি নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
বাবার কবর জিয়ারত থেকে শুরু করে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা—সব মিলিয়ে তারেক রহমানের এই কর্মসূচি শুধু ব্যক্তিগত আবেগ নয়, বরং দেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।