মনির হোসেন, মোংলা:: ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪৯ দস্যুকে আটক করেছে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন। এসময় জব্দ করা হয়েছে বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ। ২৯ ডিসেম্বর সোমবার সকাল ১১টায় বিজিসি বেইজ মোংলায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার
ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মেসবাউল ইসলাম।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দেশের উপকূলীয় ও নদীতীরবর্তী অঞ্চলে নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, বনজ সম্পদ সংরক্ষণ, মৎস্যসম্পদ রক্ষা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবিক সহায়তা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলদস্যু ও বনদস্যু নির্মূল, জেলেদের নিরাপত্তা প্রদান এবং সমুদ্র ও নৌপথে অবৈধ কার্যক্রম প্রতিরোধে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড জনগণের আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় ও নদীতীরবর্তী অঞ্চল, মোংলা বন্দর ও অন্যান্য কেপিআই সমূহের নিরাপত্তা প্রদানসহ চোরাচালান প্রতিরোধ, বনজ সম্পদ সংরক্ষণ, মৎস্যসম্পদ রক্ষা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবিক সহায়তা প্রদান করে আসছে।
জানুয়ারি হতে এখন পর্যন্ত সুন্দরবনে ডাকাত ও জলদস্যু বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে মোট ৩৮ টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২টি হাত বোমা, ৭৪টি দেশীয় অস্ত্র, অস্ত্র তৈরির বিপুল সরঞ্জামাদি, ৪৪৮ রাউন্ড কার্তুজ এবং ডাকাতদের কাছে জিম্মি থাকা ৫২ জন নারী ও পুরুষ উদ্ধার করা হয়। এসব অভিযানে মোট ৪৯ জন ডাকাতকে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
একইসাথে মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে ৫,৬৭৪ পিস ইয়াবা, ১৩ কেজি গাঁজা, ১,২৫৬ বোতল বিদেশি মদ ও বিয়ারসহ মোট ৫১ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তিনি আরো বলেন, বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ সংরক্ষণ অভিযান পরিচালনা করে ৮২৪ কেজি হরিণের মাংস ও হরিণের বিভিন্ন অঙ্গসহ ৬০০ টি হরিণের ফাঁদ জব্দ করা হয় এবং ২৯ জন হরিণ শিকারিকে আটক করা হয়। এছাড়া ১৪০০ পিসেরও বেশি গেওয়া ও গড়ান কাঠ, ২ টি তক্ষক, ৬২ টি বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ এবং ৩,৪০০ কেজি পলিথিন জব্দ করা হয়। অবৈধ মৎস্য আহরণ বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে প্রায় ১৪৭৩ কোটি টাকা সমমূল্যের ১২ কোটি মিটারেরও বেশি অবৈধ জাল এবং ১২০ কোটি টাকা সমমূল্যের রেণুপোনা, ১৪ হাজার কেজি জেলি পুশকৃত চিংড়ি জব্দ করা হয়।
এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলে আর্তমানবতার সেবায় কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন চলতি বছরে ২,০০০ এর বেশি দুস্থ, অসহায় ও শিশুদের চিকিৎসাসেবা ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ করেছে। কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন পরিবার কল্যাণ সংঘ উপকূলীয় অঞ্চলে ৫০০ এর বেশি অসহায়, গরীব ও দুঃস্থ শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, জেলে, মাঝি, পেশাজীবী ও সাধারণ জনগণের উপস্থিতিতে পরিবেশ ও বন রক্ষা, বনজ প্রাণী সংরক্ষণ, দুর্যোগকালীন উদ্ধার কার্যক্রম এবং অগ্নি নির্বাপণ বিষয়ে তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ প্রদানসহ কিশোর-তরুণদের মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রতকরণ এবং মাদক বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধিতে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছি। নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা যায়, সে লক্ষ্যে কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের আওতাধীন উপকূলীয় এলাকাসমূহে ইতিমধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য কোস্ট গার্ড সদস্যদের নির্বাচন কেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। অত্র অঞ্চলের জনগণের নিরাপত্তা এবং অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করতে কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন সর্বদা সজাগ ও প্রস্তুত থাকবে।
অত্র অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সফরকালীন সময়ে কোস্ট গার্ড কর্তৃক নৌপথে নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। সুন্দরবনের আগত পর্যটকদের দুর্ঘটনা রোধে কোস্ট গার্ড পর্যটকবাহী নৌযানসমূহে লাইফ জ্যাকেটের ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন রোধে নিয়মিত টহল কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর ফলে সুন্দরবনে আগত পর্যটকদের নৌপথে নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, বন বিভাগ, মৎস্য অধিদপ্তর এবং অন্যান্য মেরিটাইম সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে আসছে। কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন শুধু উপকূলীয় নিরাপত্তা নয়, বরং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের জান-মাল রক্ষা, বন্দর নিরাপত্তা, বনজ সম্পদ সংরক্ষণ এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জন করেছে এবং ভবিষ্যতেও এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।