মনির হোসেন:: দেশের সমুদ্রসীমা ও উপকূলীয় এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচার দমন, অবৈধ ট্রলিং প্রতিরোধ ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোন।
রবিবার (১৭ আগস্ট) সকালে কোস্টগার্ড মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম-উল-হক এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোন দেশের সুবিশাল সমুদ্র, উপকূলীয় এবং নদী তীরবর্তী অঞ্চলের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এসকল এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল রক্ষা, চোরাচালান ও মাদক পাচার দমনের পাশাপাশি নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ সহায়তা প্রদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড মানুষের মাঝে নিরাপত্তা ও আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও কোস্ট গার্ডের নিরলস প্রচেষ্টায় পায়রা বন্দর বর্তমানে একটি নিরাপদ বন্দরে পরিণত হয়েছে। কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোন অধীনস্থ এলাকায় নিয়মিত ফুট পেট্রোল প্রদান, জাহাজ এবং উচ্চ গতি সম্পন্ন বোটের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলে টহল প্রদান, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় কিউআরএফ ও ডাইভিং টিম মোতায়েনের মাধ্যমে নিরাপত্তা প্রদান করে আসছে।
জাটকা নিধন, মা ইলিশ সংরক্ষণ ও মৎস্য সম্পদ রক্ষায় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনে পরিচালিত অভিযানে প্রায় ৪,২২৪ কোটি টাকা মূল্যের ৬৫ কোটি মিটার অবৈধ জাল, ১,৫০০ টি বেহুন্দি জাল ও ৫,৬০০ টি চায়না দুয়ারি জাল জব্দ ও ধ্বংস করা হয়। এছাড়াও প্রায় ২৩ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা মূল্যের ১ লক্ষ ৭৭ হাজার কেজি জাটকা, ২০ হাজার কেজি ইলিশ মাছ, ৩১ হাজার কেজি সামুদ্রিক মাছ, ১৭ হাজার কেজি পাঙ্গাস পোনা এবং ৬ কোটি ৭২ লক্ষ পিস চিংড়ির রেণু পোনা জব্দ করা হয়। জব্দকৃত পোনা নদীতে অবমুক্ত করায় মাছের বিচরণ পূর্বের তুলনায় বর্তমানে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় কিছু অসাধু জেলে ও ব্যবসায়ী অধিক লাভের আশায় বোটে অবৈধ ট্রলিং গিয়ার ও কারেন্ট জাল সংযোজন করে মাছ ধরছে। এতে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র ধ্বংস, মাছের প্রজনন ব্যাহত ও স্থানীয় জেলেদের জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোন নিয়মিত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে সম্প্রতি আনুমানিক ১৩৫ কোটি টাকা মূল্যের ১৩৩ টি অবৈধ ট্রলিং বোট জব্দ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
গোয়েন্দা তৎপরতা এবং সার্বক্ষণিক টহল কার্য পরিচালনার মাধ্যমে গত পাঁচ মাসে ২৯ টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৮ রাউন্ড তাজা গোলা, ১ রাউন্ড গোলার খোসা, ২৭ টি হাত বোমা, ৪ টি রকেট ফ্লেয়ার, ৩৯ টি দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও ২০ লক্ষ ৫ হাজার টাকা মূল্যের ডাকাতি করা ২৩৪.৬৯২ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালংকার, ৩০.৬২ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের প্রলেপযুক্ত অলংকার এবং ১২৬.১২ গ্রাম ওজনের রুপার অলংকার উদ্ধারসহ ৪৩ জন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও ডাকাত আটক করা হয়। মাদক বিরোধী অভিযানে প্রায় ২১ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকা মূল্যের ১৮ কেজি ৮৪০ গ্রাম গাঁজা, ৫ টি গাঁজা গাছ ও ৩,১৯৭ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। চোরাচালান বিরোধী অভিযানে প্রায় ২ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা মূল্যের ৫,৯০০ কেজি হাঙর, ৮৪৫ কেজি শাপলা পাতা, ৩০,০৮০ কেজি অবৈধ পলিথিন, ১০,২৫০ লিটার অবৈধ অপরিশোধিত পাম ওয়েল জব্দ করা হয়। এছাড়াও ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা মূল্যের ১৯০ কেজি হরিণের মাংস, ১টি হরিণের সিং এবং প্রায় ৭ লক্ষ ৫৪ টাকা মূল্যের ৫,৮৮৯ টি বিভিন্ন ধরনের আঁতশবাজি ও ১৯,৬০০ স্টিক বিভিন্ন বিদেশি ব্রান্ডের সিগারেট ও অবৈধ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আটক করা হয়েছে।
অবৈধ বালু উত্তোলন রোধে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোন কর্তৃক স্থানীয় জনসাধারণের অভিযোগ এবং নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে গত ০৬ মাসে ১০৯ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা মূল্যের ৭০টি ড্রেজার ও ৫৮টি বাল্কহেড জব্দ করা হয়েছে।
গত ছয় মাসে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের মেডিক্যাল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ১,১২০ জন অসহায়, গরিব ও শিশুকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। সার্চ ও রেসকিউ অভিযানে ৫২০ জনকে জীবিত এবং ৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও, কোস্ট গার্ড পরিবার কল্যাণ সংঘের সহযোগিতায় বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও পরিচালিত হয়েছে। গত ১০ এপ্রিল জলদস্যুদের কবল থেকে ৪টি ফিশিং ট্রলার ও ৬৭ জন জেলেকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেছে কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের নিয়মিত অভিযানে ১৯ জন দুষ্কৃতিকারীকে আটক করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় চোরাচালান ও মাদক পাচার রোধে ২৪ ঘণ্টা টহল চালু রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ‘তারুণ্যের উৎসব-২০২৫’ উপলক্ষ্যে ভোলায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মৎস্য সংরক্ষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগকালীন উদ্ধার ও অগ্নি নির্বাপণ বিষয়ক সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সুনীল অর্থনীতিকে সমৃদ্ধশীল করার লক্ষ্যে সমুদ্র, উপকূলীয় এবং নদী তীরবর্তী অঞ্চলে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। ভবিষ্যতেও উক্ত কার্যক্রমসমূহ অব্যাহত থাকবে।
Leave a Reply