বিশেষ প্রতিনিধি:: শিল্পাঞ্চলে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড সরকারের নাশকতা সন্দেহে বিবৃতি নিরাপত্তা শঙ্কায় শ্রমিকরা
গত বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে চট্টগ্রাম ইপিজেডের অ্যাডামস ক্যাপ হাউসে আগুন লাগে। প্রায় ১৭ ঘণ্টা পর শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন। পুড়েছে আটতলা ভবনের পুরোটাই। তবে শ্রমিকদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়ায় কেউ হতাহত হয়নি। ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করেছে ইপিজেড কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিস।
এছাড়া সম্প্রতি মিরপুরের শিয়ালবাড়ির অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং দগ্ধ হয়েছে অনেকে। এ ঘটনায় গুদামের রাসায়নিক পদার্থ পুড়ে ক্লোরিন গ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেই এলাকাজুড়ে বিশেষ সতর্কতা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে আজ শনিবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। এর ফলে প্রায় সাত ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর রাত ৯টা থেকে বিমানবন্দরের সব ধরনের ফ্লাইট কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হয়েছে।
আগুন লাগার পর সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নাশকতার প্রমাণ পেলে দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সাধারণ জনগণ আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই, সরকার প্রস্তুত।
এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।
তবে শিল্পাঞ্চলে, যেখানে এই আগুনের ঘটনা ঘটেছে সেখানে এখনও ভয় বিরাজ করছে। শ্রমিকরা বলছেন, প্রস্তুতি কাগজে আছে, কিন্তু বাস্তবে আগুন লাগলে নিরাপদে বেরোবার পথ ঠিকমত নিশ্চিত করা যায় না।
ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক তদন্তে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ইপিজেডে আগুনের সূত্রপাত সম্ভবত বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে হয়েছে। তবে সরকারের বিভিন্ন সূত্রে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, এই ঘটনা কেবল প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়, বরং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির একটি সম্ভাব্য প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন শিল্প এলাকায় অস্বাভাবিকভাবে ধারাবাহিক আগুন লাগার ঘটনা বেড়ে গেছে। গত তিন মাসে অন্তত ৪৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, টঙ্গী ও চট্টগ্রামে। এর মধ্যে অন্তত ২১টি ঘটেছে পোশাক ও রপ্তানিমুখী কারখানায়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা নিছক কাকতালীয় ঘটনা নয়। যখন দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হওয়ার পথে, তখন শিল্পখাতে একের পর এক আগুন জাতীয় উৎপাদন ও রপ্তানি আয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকার আগুনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যদি অগ্নিসংযোগ বা নাশকতার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে, বিশেষ করে শিল্পাঞ্চল, গুদাম এলাকা ও বন্দরনগর চট্টগ্রামে। ইতিমধ্যে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা আগুনের পেছনে কোনো সংগঠিত হাত আছে কি না, তা অনুসন্ধান করছে।
একজন জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটা এখন শুধুই অগ্নি নিরাপত্তার বিষয় নয়, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
এদিকে সরকারের ‘প্রস্তুতি’ ঘোষণার বিপরীতে শ্রমিকদের বক্তব্য একেবারেই ভিন্ন।
চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক রহিমা বেগম বলেন, আমরা প্রতিদিনই আগুনের ভয়ে কাজ করি। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আছে, কিন্তু ক’জন জানে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়? ফায়ার অ্যালার্ম বাজলে কোথা দিয়ে বের হব তাও অনেকেই জানে না।
টঙ্গীর একটি প্লাস্টিক কারখানার কর্মী রফিকুল ইসলাম বলেন, ফ্যাক্টরির মালিক বলেন ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেট আছে। কিন্তু মাসে একবারও মহড়া হয় না। আগুন লাগলে কারও দিকে তাকিয়ে থাকলে জীবন বাঁচবে না।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) স্বীকার করেছে, অনেক কারখানায় এখনো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মানদণ্ড পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেন, যদি এটা নাশকতা হয়, তবে উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক স্থিতি ও সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস করা। আর যদি নাও হয়, এতগুলো দুর্ঘটনা নিজেই প্রমাণ করে, আমরা নিরাপত্তা অবকাঠামো নিয়ে প্রস্তুত নই।
শিল্প নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, আমাদের কারখানাগুলোর অন্তত ৬০ শতাংশে জরুরি নির্গমন পথ, অগ্নি সতর্কতা ব্যবস্থা বা পর্যাপ্ত পানির রিজার্ভ নেই।
ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে মোট ২৬,৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, যার মধ্যে ৩৪ শতাংশই শিল্পখাতে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬,৫০০ কোটি টাকা, আর প্রাণহানি ঘটেছে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের।
সরকার যেখানে নাশকতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না, সেখানে বিরোধী দলগুলো বলছে এটি অকার্যকর প্রশাসন ও অব্যবস্থাপনার ফসল।
বিরোধী রাজনৈতিক জোটের এক নেতা বলেন, প্রতিবার আগুন লাগলেই সরকার বলে নাশকতা, কিন্তু কেউ ধরে না। এটা দায়িত্ব এড়ানোর উপায়।
তবে সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আগুনের সময়, স্থান ও ধরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই এটি “অস্বাভাবিকভাবে সমন্বিত”যা ইঙ্গিত দেয় পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের দিকে।
রপ্তানি খাতের ওপর এই ধারাবাহিক আগুনের প্রভাব ইতোমধ্যেই স্পষ্ট। গত মাসে পোশাক রপ্তানি ৫.৭ শতাংশ কমেছে, আর নতুন ক্রেতাদের অর্ডারও স্থগিত রেখেছে কয়েকটি ইউরোপীয় ব্র্যান্ড।
বাণিজ্য বিশ্লেষক মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড মানে শুধু সম্পদের ক্ষতি নয় বিদেশি ক্রেতার আস্থার ক্ষতিও। একবার আস্থা হারালে তা ফিরে পেতে বছর লাগে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়ে ৫৭ বিলিয়ন ডলার হলেও ধারাবাহিক আগুনে সেই গতি থমকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শিল্প বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের করণীয় প্রস্তুতিকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। তারা মনে করেন, কারখানা চালু রাখতে হলে বছরে অন্তত একবার অগ্নি নিরাপত্তা অডিট বাধ্যতামূলক করতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের মহড়া ও উদ্ধার প্রশিক্ষণ নিয়মিত করতে হবে। প্রতিটি শিল্পাঞ্চলে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সিভিল ডিফেন্সের যৌথ টাস্কফোর্স থাকতে হবে। সরকারি তদন্ত কমিটি যেন ফলাফল প্রকাশ করে, দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনে।
তবে সরকার বলছে, ভয়ের কিছু নেই, আমরা প্রস্তুত। কিন্তু শ্রমিকরা এখনো ভয় নিয়ে কাজ করেন। আগুন নিভলেও ধোঁয়া থেকে যায়। এই আগুন কেবল একটি ফ্যাক্টরির দেয়াল পোড়ায় না এটি প্রশাসনিক শিথিলতা, নিরাপত্তা অবহেলা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখোশ উন্মোচন করে।
যদি প্রস্তুতি সত্যিই বাস্তবে পরিণত হয়, তবে হয়তো একদিন শ্রমিকরা বলতে পারবেন, আমরা শুধু আগুনে কাজ করি না, নিরাপত্তার আলোতেও কাজ করি।
Leave a Reply