
ক্রীড়া প্রতিবেদক, ঢাকা:: বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটে নীরব উত্তাপ জমেছে একদিকে অভিযোগ, অন্যদিকে তদন্তের প্রস্তুতি। জাতীয় দলের অভিজ্ঞ পেসার জাহানারা আলম সম্প্রতি কয়েকটি সাক্ষাৎকারে নারী ক্রিকেটের ভেতরের অনিয়ম, অবৈধ সিন্ডিকেট এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন।
তার বক্তব্যে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে, সেটি এখন গড়িয়েছে সরাসরি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) হাতে।
রোববার মিরপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও মিডিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন নারী ক্রিকেটে ওঠা এই অভিযোগ নিয়ে মুখ খোলেন।
বিসিবির মিডিয়া বিভাগের প্রধান আমজাদ হোসেন বলেন, ভিডিও ইন্টারভিউটি দেখার পরপরই আমরা বিষয়টি আমলে নেই। একজন বিচারকের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দেবে।
তিনি আরও জানান, তদন্তকালে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের সাময়িকভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি (ওএসডি) দেয়া হতে পারে। এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে প্রয়োজন মনে হলে সেটা করা হবে,বলেন তিনি।
জাহানারার করা অভিযোগ নতুন নয় ২০২১ সালেও বিসিবিতে একটি যৌন হয়রানির অভিযোগ জমা পড়েছিল, যা সে সময় ‘নিষ্পত্তি’ করা হয়েছিল। কিন্তু এবার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিসিবি নিজ থেকেই তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সভাপতি বুলবুল বলেন, তখন আমরা মনে করেছিলাম বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে। নতুন করে এখন কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি, তবুও আমরা নিজেরা তদন্ত শুরু করেছি। কেউ যদি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দেয়, সেটি আমরা আরও গুরুত্ব সহকারে দেখব।
নারী ক্রিকেটের কাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে বিসিবি সভাপতির বক্তব্য ছিল বেশ খোলামেলা। তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয়, নারী ক্রিকেট এখনো অবহেলিত। আমি চাই নারী উইংয়ে নারী পরিচালক থাকুক। বিসিবির গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের ক্ষমতা এখন আমার হাতে নেই, কিন্তু পরিবর্তন সম্ভব হলে প্রথমেই আমি চাইবো কয়েকজন নারী পরিচালক আসুক।
তিনি জানান, ভবিষ্যতে কোচিং, আম্পায়ারিং বা প্রশিক্ষণের যেকোনো কোর্সে জেন্ডার সমতা বজায় রাখা হবে। যে ছেলে বা মেয়ে খেলতে আসে, তাদের মাঠের ভেতরে ও বাইরে সমান মর্যাদা দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যোগ করেন তিনি।
বুলবুল নারী ক্রিকেটের সাম্প্রতিক সাফল্যের কথাও তুলে ধরেন। তার মতে, বাংলাদেশের মেয়েরা এখন এমন মানের ক্রিকেট খেলছে, যা আগে কেউ ভাবতেও পারেনি।
তিনি উদাহরণ টানেন সর্বশেষ নারী বিশ্বকাপের, যেখানে বাংলাদেশের ফাস্ট বোলার মারুফা আক্তারের পারফরম্যান্স আন্তর্জাতিক ধারাভাষ্যকারদেরও দৃষ্টি কেড়েছিল।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মারুফার ইনসুইং দেখে অনেকেই বলেছে, এমন ডেলিভারি নাকি বহুদিন দেখেনি বলে জানান তিনি
তবে নারী ক্রিকেটের ভেতরে অবৈধ সিন্ডিকেট বা লবিং সংস্কৃতি র অভিযোগটি এবার বিসিবির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ক্রীড়া বিশ্লেষকদের মতে, অভিযোগগুলো যদি আংশিক সত্যও হয়, তবে সেটি বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট কাঠামোর জন্য বড় সতর্কবার্তা।
একজন সাবেক নারী ক্রিকেটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক সময় যোগ্যতা নয়, সম্পর্কই নির্ধারণ করে কারা সুযোগ পাবে। যদি তদন্ত সঠিকভাবে হয়, তাহলে হয়তো বহুদিনের জমে থাকা অভিযোগের অবসান ঘটবে।
নারী ক্রিকেটারদের জন্য নিরাপদ, স্বচ্ছ ও সম্মানজনক পরিবেশ তৈরিতে এখন বিসিবির সামনে পরীক্ষার সময়। বুলবুল বলেন, আমরা চাই না কেউ অবহেলিত বোধ করুক। নারী ক্রিকেট আমাদের গর্ব—এখানে কেউ নিপীড়নের শিকার হবে, এমন অবস্থান বিসিবি কখনো নেবে না।
এদিকে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ ও কয়েকজন বোর্ড কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিসিবি এখন নারী উইং পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রতিটি বিভাগে আলাদা কোচ ও মনিটরিং সেল গঠন করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
জাহানারার অভিযোগ এখন শুধু একজন খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়; এটি নারী ক্রিকেটে নিরাপত্তা, সম্মান এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে।
আগামী ১৫ দিনের তদন্ত-রিপোর্ট শুধু একটি ঘটনার পরিণতি নির্ধারণ করবে না—এটি নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কতটা নিরাপদ, স্বচ্ছ এবং পেশাদার হবে।
Leave a Reply