
বিশেষ প্রতিবেদক:: ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মহলে উত্তাপ-উদ্বেগ-জল্পনা মিলেমিশে এক ধরনের চাপা অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই অস্থিরতার মাঝেই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম মন্তব্য করেছেন, এবারের নির্বাচন সাম্প্রতিক সময়ের তুলনায় সবচেয়ে শান্ত পরিবেশেই সম্পন্ন হতে পারে।
শনিবার সকালে নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসে তিনি তিনটি সাম্প্রতিক ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলেছেন, চাইলে এখন আর কোনো দল ভোটের মাঠকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো শক্তি দেখাতে পারবে না। এই বাস্তবতা আরও স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের তৃণমূল ভেঙে গিয়েছে, তাদের হাতে আর বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরির সক্ষমতা নেই।
স্ট্যাটাসটি প্রকাশের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় ওঠে। কারণ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে নিয়ে এমন মূল্যায়ন রাষ্ট্রের শীর্ষ নির্বাহী কাঠামো থেকে প্রকাশ্যে খুব কমই শোনা যায়। তিনি দাবি করেন, গত কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহ, দলগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং মাঠ-প্রশাসনের আচরণ মিলিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশকে এখন অধিকতর স্থিতিশীল বলা যায়।
স্ট্যাটাসে প্রথম যে দিকটি তিনি তুলে ধরেন তা হলো, বিএনপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে আগাম আশঙ্কা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেছিলেন, মনোনয়ন দিতে গিয়ে বিএনপির ভেতর মারাত্মক ভাঙন দেখা দিতে পারে। ধারণা ছিল, শত শত বিদ্রোহী প্রার্থী দলীয় সিদ্ধান্ত অস্বীকার করে রাস্তায় নামবে, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ হবে, এমনকি সংঘর্ষও বাঁধতে পারে।
কিন্তু বাস্তবতা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুটি-একটি বিচ্ছিন্ন ক্ষোভ ছাড়া বিএনপির মনোনয়ন প্রক্রিয়া মোটামুটি নির্বিঘ্নেই শেষ হয়।
শফিকুল আলম লিখেছেন, এতে প্রমাণিত হচ্ছে বিএনপি নেতৃত্ব এইবার অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতিকে প্রাধান্য দিয়েছে। অনেকদিন পর দলের ভেতরে একটি সুসংগঠিত অবস্থার ইঙ্গিত মিলেছে, যা ভোটের দিন সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, মনোনয়ন বণ্টন একটি দলের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ধাপ। যদি সেখানেই তীব্র রেষারেষি না দেখা যায়, বোঝা যায় দলটি প্রচারণার সময়ও অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রাখতে পারবে।
স্ট্যাটাসের দ্বিতীয় অংশটিই সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে একটি ব্যাপার তুলে ধরেছে তাদের নাকি বিস্তৃত তৃণমূল নেটওয়ার্ক আছে, যা ইচ্ছে করলে যেকোনো নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তাদের সেই শক্তি এখন আর নেই।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, দলটির মাঠপর্যায়ের মূল সংগঠন ভেঙে পড়েছে। অনেক পুরোনো নেতা-কর্মী নিষ্ক্রিয়, কেউ কেউ অন্য দলে চলে গেছে, আর যারা রয়ে গেছে তারাও সংগঠিত নয়।
তিনি দাবি করেন, এখন আওয়ামী লীগ যে ধরনের ‘অ্যাকশন’ দেখাতে সক্ষম, তা মূলত ভাড়াটে কয়েকটি গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল।
আওয়ামী লীগ এর কাজ হচ্ছে- রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পুরোনো বাসে আগুন ধরানো, কয়েক সেকেন্ডের ঝটিকা মিছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত করা।
শফিকুল আলমের মতে, এগুলো বৃহৎ পরিসরে নির্বাচন ব্যাহত করার মতো শক্তি নয়। এটা শুধু চমক সৃষ্টি করে। দেশে বড় মাত্রার রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা তাদের হাতে এখন আর নেই।
এ মন্তব্য স্পষ্টতই ইঙ্গিত করে যে, তাঁর মূল্যায়নে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাবের কেন্দ্র এখন আর মাঠে নয়, বরং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে, যেখানে কয়েকটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী শব্দ তুলতে পারে, কিন্তু দেশজুড়ে সংঘাত সৃষ্টি করার মতো শক্তি দেখাতে পারে না।
স্ট্যাটাসে তৃতীয় যে বিষয়ের কথা তিনি বলেন, তা হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের প্রস্তুতি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশে সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দৃশ্যমানভাবে উন্নতি হয়েছে। রাজনৈতিক উত্তাপের মাঝেও বড় কোনো সহিংসতা না হওয়াকে তিনি এ প্রস্তুতির প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন।
তিনি জানান, নির্বাচন পরিচালনায় যেসব জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং ওসি দায়িত্ব পালন করবেন তাদের মধ্যে অনেকেই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার কারণে আগেই নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। এবার তাদের মধ্যে সমন্বয় আরও পোক্ত, যা ভোটারদের নিরাপত্তাবোধ বাড়াতে সাহায্য করবে।
তাঁর ভাষায়, মাঠ প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মানসিক প্রস্তুতিও আগের চেয়ে বেশি। তারা জানেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে জাতির প্রত্যাশা এখন অনেক। আমি বিশ্বাস করি, তারা সেই প্রত্যাশার যথাযথ প্রতিফলন ঘটাবেন।
প্রেস সচিবের স্ট্যাটাস রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নতুন করে আলোচনার বিষয় তৈরি করেছে। বিএনপি বা জামায়াত ও এনসিপিসহ আরও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ভেতরকার প্রস্তুতি কিংবা বাস্তবতা সব মিলিয়ে নির্বাচনী পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সে বিষয়ে এখন নানা বিশ্লেষণ চলছে। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, মাঠ-পর্যায়ে যে স্থিতিশীলতার কথা শফিকুল আলম বলেছেন, তা ভোটের দিন পর্যন্ত টিকবে কি না।
তবে তাঁর মূল্যায়ন অনুযায়ী বর্তমান বাস্তবতা বলছে, বড় ধরনের সহিংসতা বা নাশকতার ঝুঁকি আগের বছরের তুলনায় অনেক কম, এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোর আচরণও তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত।
Leave a Reply