পাইকগাছা(খুলনা)প্রতিনিধি:: খুলনার পাইকগাছার বাজার খোলার দোল মন্দিরের স্মৃতিচিহ্ন মুছে যেতে বসেছে। প্রতিষ্ঠানগুলি ভেঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় স্মৃতিচিহ্ন মুছে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে ইতিহাস। কালের স্বাক্ষী হয়ে সুখদা সুন্দরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৩শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ভাঙ্গা দোল মন্দির ও আম গাছটি।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আর মন্দির কমিটির অবহেলা, নজরদারি, সংস্কার কিংবা পুনঃনির্মান না করায় মন্দিরটি ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ে দোল মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতিচিহ্নের শেষটুকু। কালের স্বাক্ষী বাজার খোলার ঐতিহ্যবাহী আম গাছটি নিয়ে নানা কৌতুহল রয়েছে। এ গাছটিকে ঘিরে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, মন্দির, পুকুরসহ উন্মুক্ত পরিবেশ। এই স্থানটি আবার বাজারখোলা নামে পরিচিত।
জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে দোল মন্দিরটি পুনঃনির্মাণের জন্য চার লক্ষ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়। তবে, সরকার পতনের ফলে সে বরাদ্ধ ও উন্নয়ন কাজ স্থগিত রয়েছে।
বাজার খোলায় জমিদার ভোলানাথ ঘোষের কাছারি বাড়ি ছিলো। জমিদারির খাজনা আদায় করা হতো কাছারিতে বসে। খাজনা আদায় শেষে এখানে গান ও যাত্রাপালা হতো। কলকাতা থেকে যাত্রাদল আনা হতো। প্রায় সাত দিন ব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলতো। দোল মন্দির, দূর্গা মন্দির, গাছতলা মন্দির ও বারের পুকুর মিলে নাম হয় বাজার খোলা। এটি এ এলাকার ঐতিহ্যবাহী স্থান।
পাইকগাছার উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত বাজারখোলা ও ভোলানাথ সুখদা সুন্দরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। শুরুতে এখানে টোলে পড়ানো হতো। টোল বসতো মন্দিরের ঘরে। পন্ডিত শীকান্ত ভট্রাচার্য এ এলাকায় পূজা করতেন এবং টোলে ছেলে-মেয়েদের পড়াতেন। এরপর ১৯২৩ সালে সুখদা সুন্দরী এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয় চত্তরে প্রায় ৩শত বছরের গাছটি কালের স্বাক্ষী হিসাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস শেষে মুক্ত বাতাসে গাছের তলায় বসে গল্প করে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ডালগুলিতে বসে ছাত্র-ছাত্রীরা দোল খায়। তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। গাছ তলায় জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকা আম পড়লে তা কুড়াতে হুড়োহুড়ি লাগে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে।
গাছটির সাথে কালের স্বাক্ষী হিসেবে জড়িয়ে রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের বেদ মন্দির, দোল মন্দির, দূর্গা মন্দির ও বারের পুকুর। জমিদার আমলে নির্মিত এ মন্দিরটিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এখনও উপাসনা করেন। এখানে প্রতি বছর চৈত্রের মাসের শেষ তারিখে চড়ক পূজা, মেলা ও পহেলা বৈশাখের মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
স্কুলের উন্নয়নের ছোয়া লাগলেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি দিন দিন দেখাশুনার অভাবে নষ্ঠ হওয়ার পথে। ১৯৮৮ সালে ঘূর্ণিঝড়ে দোল মন্দিরটি ভেঙ্গে যায়। মেইন সড়ক থেকে মন্দির ও পুকুরে প্রবেশ করতে পৃথক পথ যার দুই পাশে প্রাচীর ছিলো। মেইন সড়ক থেকে মন্দিরের প্রবেশ পথে দুই পাশে উচু গুম্বজ ছিল। পুকুরের তিন পাশে পাঁকা ঘাট ছিল।
স্থানীয় পুরাইকাটী গ্রামের সুনিল সেন (৮০) এবিষয়ে বলেন, আমি এ স্কুলে পড়েছি। চাটাই বিছিয়ে তালের পাতায় দোয়াত ও কুঞ্চির কলম দিয়ে লিখতাম। জমিদার ভোলানাথ এলাকাবাসীর পানীয় জলের জন্য বারের পুকুরসহ ৭টি পুকুর খনন করেন। আম গাছটি পিছনে রয়েছে বারের পুকুর। বারের পুকুরের বড় বড় দুটি গজাল মাছ ভেসে রেড়াতে দেখতাম। পুকুরটিতে অলৌকিক কিছু দেখা যেত বলে নাম রাখা হয়েছিল বারের পুকুর।
ভোলানাথ সুখদা সুন্দরী সর্বজনীন মন্দির কমিটির সভাপতি অশোক কুমার ঘোষ বলেন, বাজার খোলা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন। এগুলো আমাদের অতীত নিদর্শন। দোল মন্দির সংস্কারের উদ্যেগ গ্রহণ করা হয়েছে। মন্দিরসহ ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ, ও সংস্কার করা বিশেষ প্রয়োজন বলে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
রাস্তার পূর্ব পাশে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী গদাইপুর খেলার মাঠ। সবমিলিয়ে গাছটির সাথে মিলে-মিশে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ ও মন্দির। এতিহ্যবাহী বাজার খোলা ঘিরে রয়েছে ৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৩টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, পুকুর ও ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠ। এ বাজার খোলার মনোমুগ্ধকর উন্মুক্ত পরিবেশ সবাইকে আকৃষ্ট করে। বিলিন প্রায় প্রতিষ্ঠান গুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলে ঐতিহ্যবাহী বাজার খোলার স্মৃতি ধরে রাখা সম্ভব হবে বলে এলাকাবাসী দাবী করেন।
Leave a Reply