
বিবিসি বাংলা:: বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ‘বিতর্কিত ভূমিকা’র পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বিএনপি সুনির্দিষ্ট কয়েকজনের বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ’ করেছে। সেই সাক্ষাতের পরদিন বুধবার জামায়াতে ইসলামী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করে কিছু উপদেষ্টার ব্যাপারে ‘আপত্তি’ জানিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নেতারাও একই অভিযোগ জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি করা ‘বিতর্কিত উপদেষ্টা’ কারা, কেন দলগুলো এমন অভিযোগ তুলছে—এ নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিসি বাংলা। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা অনেক দিন ধরেই কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করে আসছেন। যদিও কোন কোন উপদেষ্টা নিরপেক্ষ নন বা কারা বিতর্কিত—তাদের নাম প্রকাশ করেনি জামায়াত ও এনসিপি।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপির অভিযোগ কিছু উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করছে। বিশেষ দল বলতে তারা জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করছে। জামায়াতও একইভাবে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে অভিযোগ করে আসছে। আর এনসিপির অভিযোগ বিএনপি ও জামায়াতকে লক্ষ্য করে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জনপ্রশাসনে বদলি-পদায়নে বড় দলগুলোর ‘ভাগ-বাটোয়ারায়’ উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে।
বিএনপির চোখে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের প্রসঙ্গে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দলটির যে নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন, তাদের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ‘বিতর্কিতদের তালিকায়’ এক নম্বরে রয়েছেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি প্রশাসনে রদবদলের কেবিনেট কমিটিতে রয়েছেন। এ কমিটির আরেকজন সদস্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব শেখ আব্দুর রশীদের নাম উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধেও একটি বিশেষ দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ জানিয়েছে বিএনপি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। ওই মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার পরই খোদা বখস চৌধুরীর অবস্থান। বিএনপি নেতারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে খোদা বখস চৌধুরীর বিরুদ্ধেও একটি দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ দিয়েছেন।
কোনো কোনো উপদেষ্টা রাজনীতি বা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন বলে অভিযোগও জানিয়েছে বিএনপি। এ অভিযোগের ক্ষেত্রে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে থাকা উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার দিকে আঙুল তুলেছে দলটি।
দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সরকারের যাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের ও কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ তারা এনেছেন, তাদের যেন সরকার থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, এই আবেদনও তারা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার কাছে। বিএনপি যাদের নাম দিয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বক্তব্য পায়নি বিবিসি বাংলা।
তবে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে দলগুলোর প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে কয়েকদিন আগে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, যেহেতু বড় সব দলই অভিযোগ করছে, ফলে সরকার ঠিক পথে আছে বলে তিনি মনে করেন।
কিছু উপদেষ্টার নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি বিএনপি বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুডে বা আদলে কাজ করবে বলে তারা চাইছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে কাজ করবে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে সেই আবেদন জানিয়েছেন তারা।’
সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাস মেয়াদের যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, সেই ব্যবস্থায় ১৯৯৬ সালে এবং ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৮ সালেও নির্বাচন হয়েছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেই নির্বাচনে ক্ষামতায় এসে আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ শাসনের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এক রিট মামলায় হাইকোর্ট আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল করে। হাইকোর্ট আদেশের ওপর এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল আবেদনের শুনানি চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে কাজ করে, তাহলে এ সরকারকে নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ড বাদ দিতে হবে। সরকারকে শুধু নির্বাচন পরিচালনায় রুটিন কাজ করতে হবে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘এখন সরকারের অগ্রাধিকার হবে সংসদ নির্বাচন। সে কারণে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো কাজ করবে, সেটাই তারা চান। জামায়াত ও এনসিপি অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি আনছে না।’ তারা বলছে, সরকার নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে, সেটি তাদের প্রত্যাশা। আর সেই প্রেক্ষাপটে এ দল দুটিও কিছু উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিএনপির পর জামায়াতের নেতারা দেখা করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই বৈঠকে জামায়াত নেতারা তাদের অভিযোগ তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের।
তিনি সাংবাদিকদের জানান, তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে কোনো উপদেষ্টার নাম বলেননি। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসিকে বলেন, ‘অভিযোগের ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। প্রয়োজনে পরে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের নাম প্রকাশ করবেন। তবে জামায়াতের অন্য একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন উপদেষ্টার ব্যাপারে তাদের আপত্তি রয়েছে। সালেহউদ্দিন আহমেদ ওই জনপ্রশাসন সম্পর্কিত কেবিনেট কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন। ফলে জামায়াতেরও নজর যে প্রশাসন ঘিরে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।’
বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জনপ্রশাসনে বদলি-পদায়নে বড় দলগুলোর ‘ভাগ-বাটোয়ারায়’ উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। দলটির এমন বক্তব্য থেকে অনুমিত যে, তারাও প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেছে। বিএনপি, জামায়াতের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এনসিপি নেতাদের এ সাক্ষাতের পেছনে ভিন্ন কারণ ছিল বলেও দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। আর এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয় কিনা, এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ ছিল। মূলত এ উদ্বেগ নিয়েই তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। এনসিপি সূত্রগুলো জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সংখ্যা বা কলেবর বাড়ুক কিংবা কমুক, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বেই নির্বাচন হবে, এ ব্যাপারে তাদের নিশ্চিত করা হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
Leave a Reply