
নিজস্ব প্রতিবেদক:: জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথনকশা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক ও মতপার্থক্যের পর আজ অবশেষে সমাধানের একটি কাঠামো হাতে পেল অন্তর্বর্তী সরকার।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৬ ধারার একটি প্রস্তাবনা ও ১০ ধাপের বাস্তবায়ন নির্দেশনা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে হস্তান্তর করেছে।
এই খসড়ার নাম দেওয়া হয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’যার মাধ্যমে জুলাই সনদের আলোকে নতুন সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশনের মতে, জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক ও আইনি কাঠামো অপরিহার্য। গণভোট, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংস্কার সম্পন্ন করার জন্য এই আদেশকে ‘আইনসম্মত ভিত্তি’ হিসেবে দেখছে তারা।
প্রস্তাব অনুযায়ী, জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার–সংক্রান্ত অংশ জনগণের ভোটে অনুমোদনের জন্য গণভোট আয়োজন করা হবে।
ব্যালটে প্রশ্ন থাকবে, ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এর তফসিল–১–এ বর্ণিত সংস্কার প্রস্তাবসমূহে সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’
এই তফসিলে থাকবে ৪৮টি সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব, যেখানে দলগুলোর ‘ডিসেন্ট’ বা আপত্তি অন্তর্ভুক্ত করা হবে না।
গণভোটের তারিখ নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর, তবে কমিশন সুপারিশ করেছে সংসদ নির্বাচনের আগে বা একই দিনে এটি অনুষ্ঠিত হতে পারে।
গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন পেলে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ। এই পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করে সংবিধানের চূড়ান্ত পাঠ অনুমোদন করবে।
তবে নির্ধারিত সময়ে সংস্কার শেষ না হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে, কমিশনের এমন সুপারিশই সবচেয়ে আলোচিত।
নতুন সংসদের সদস্যরা প্রথমে এমপি হিসেবে শপথ নেবেন, পরে আবার সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে দ্বিতীয় শপথ নেবেন। এই দুই দায়িত্বের মধ্যে পার্থক্য থাকবে প্রথমটি আইন প্রণয়নে, দ্বিতীয়টি সংবিধান পুনর্গঠনে।
সংস্কার পরিষদের বৈঠকে কোরামের জন্য ন্যূনতম ৬০ সদস্য উপস্থিত থাকলেই আলোচনা ও ভোট গ্রহণ করা যাবে। কোনো প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিষদের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটই যথেষ্ট হবে।
প্রথম বৈঠকে পরিষদ একটি সভাপ্রধান ও উপ-সভাপ্রধান (স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের মতো) নির্বাচন করবে।
সংবিধান সংস্কারের পর ৪৫ দিনের মধ্যে নিম্নকক্ষের ভোটের আনুপাতিক ভিত্তিতে (পিআর) একটি উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে এর মেয়াদ নিম্নকক্ষের মেয়াদের সঙ্গে সমান থাকবে।
কমিশনের মতে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ জনগণের সরাসরি অনুমোদন (গণভোট) থেকে ‘গাঠনিক ক্ষমতা’ লাভ করবে। তাই পরবর্তী সময়ে সংস্কারের জন্য আলাদা সংসদীয় অনুমোদন বা ভোটের প্রয়োজন হবে না।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিএনপি ও জামায়াত, কিছু প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিল।
আজ কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের জানান, ‘এই ডিসেন্টগুলো সরকার জনগণের কাছে উপস্থাপন করবে। জনগণের রায়ই নির্ধারণ করবে কোন প্রস্তাব কার্যকর হবে।’
তার মতে, ‘কমিশন দলীয় অবস্থানের চেয়ে জনসম্মতিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এই প্রস্তাব দেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব উদ্যোগ, কারণ প্রথমবারের মতো সংবিধান সংস্কারকে গণভোটের মাধ্যমে জনতার রায় নির্ভর প্রক্রিয়ায় নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে এই রোডম্যাপ কার্যকর করতে আইন প্রণয়ন, সময়সীমা নির্ধারণ ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সমন্বয় কতটা সম্ভব হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাব এখন প্রধান উপদেষ্টার হাতে। তিনি সরকারের আইন ও নীতি–সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
জুলাই সনদের প্রতিশ্রুতি একটি ন্যায়ভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা এখন অনেকটাই নির্ভর করছে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের পরবর্তী ধাপের ওপর।
Leave a Reply