
নিজস্ব প্রতিবেদক:: বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার ও ফ্যাটি লিভারজনিত রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এখন মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, অসংক্রামক রোগ এখন আমাদের দেশের নীরব মহামারি। সময় এসেছে ক্যান্সার প্রতিরোধ ও সচেতনতার কার্যক্রমকে জাতীয় অগ্রাধিকারে আনার।
শনিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সিঙ্গাপুরের খ্যাতনামা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তো হান চংয়ের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় এখন মৃত্যুর অধিকাংশই হচ্ছে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের মতো অসংক্রামক রোগে। অথচ এগুলোর অনেকটাই প্রতিরোধযোগ্য। প্রতিরোধের পথ হচ্ছে সচেতনতা, প্রাথমিক স্ক্রিনিং এবং সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা।
তিনি আরও বলেন, একবার ক্যান্সার শনাক্ত হলে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে যায়। তাই দরকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। আমাদের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যা সাশ্রয়ী এবং বাস্তবসম্মত।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার নারী দেরিতে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। এখনই সময় জাতীয় পর্যায়ে স্বল্প ব্যয়ে স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু করার।
তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর যৌথ সহযোগিতায় ‘কমিউনিটি-ভিত্তিক স্ক্রিনিং ও সচেতনতা প্রকল্প’ চালুর প্রস্তাব দেন।
তার ভাষায়, প্রাথমিক পর্যায়ে উপজেলা হাসপাতাল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতেই প্রাথমিক স্ক্রিনিং সুবিধা চালু করা সম্ভব।
সিঙ্গাপুরের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তো হান চং বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার কোটি কোটি মানুষ এখন ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। এটি কেবল ওজন বাড়ার সমস্যা নয়, বরং ধীরে ধীরে লিভার ক্যান্সারের দিকে নিয়ে যায়। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সচেতনতা ছাড়া এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব নয়।
তিনি জানান, সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের চিকিৎসকদের সঙ্গে যৌথ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছেন, যাতে বাংলাদেশেও প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি ও প্রাথমিক নির্ণয় ব্যবস্থা আরও কার্যকরভাবে চালু করা যায়।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, স্বাস্থ্যনীতি শুধু চিকিৎসা নির্ভর হলে তা ব্যর্থ হয়। আমাদের জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোই সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। ক্যান্সারের মতো রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব, যদি আমরা সময়মতো জীবনধারায় পরিবর্তন আনি।
তিনি আরও বলেন, নারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে সরকার ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। গণমাধ্যম, স্থানীয় সরকার ও সমাজকর্মীদেরও এই প্রচেষ্টায় যুক্ত করতে হবে।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা দুই দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশি চিকিৎসক ও নার্সদের সিঙ্গাপুরে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হলে তারা দেশে ফিরে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।
অধ্যাপক তো হান চং জানান, এই সপ্তাহেই সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞরা ঢাকা ও চট্টগ্রামের চিকিৎসকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করেছেন এবং এ ধরনের কার্যক্রম প্রতিবছর অব্যাহত থাকবে।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে নারীদের স্তন ক্যান্সার আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি প্রায় ২৫ শতাংশ।
এছাড়া, প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন ফ্যাটি লিভার রোগে ভুগছেন, যা ভবিষ্যতে লিভার ক্যান্সার বা সিরোসিসে পরিণত হতে পারে।
বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু অসংক্রামক রোগের বাড়তি চাপ ভবিষ্যতের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান চিকিৎসার জন্য নয়, জীবনের জন্য সচেতনতা। ক্যান্সারের মতো ব্যয়বহুল রোগ থেকে জাতিকে সুরক্ষিত রাখতে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সামাজিক সচেতনতা এখন সময়ের দাবি।
Leave a Reply