
ডেস্ক:: রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের করিডোরে বুধবার সন্ধ্যায় ভিন্ন ধরনের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন থাকায় তাঁর চিকিৎসা সম্পর্কে খোঁজ নিতে হাসপাতালে যান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার সন্ধ্যা ৭টার কিছু পর তিনি হাসপাতালে পৌঁছালে পুরো এলাকা আরও সতর্ক হয়ে ওঠে। প্রায় আধা ঘণ্টা অবস্থান করে চিকিৎসকদের কাছ থেকে পরিস্থিতির বিস্তারিত শোনেন তিনি।
অধ্যাপক ইউনূসের সফরকে কেন্দ্র করে হাসপাতালের প্রধান ফটক থেকে আইসিইউ করিডোর পর্যন্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যুক্ত হয় এসএসএফ, পিজিআর, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা। মূল ফটকের সামনে কাঁটাতারের ব্যারিকেড টেনে দেওয়া হয়। এমন প্রস্তুতি সাধারণ কোনো হাসপাতাল সফরের চেয়ে আলাদা বার্তা দেয় দেশের একজন শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রীকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি যে কতটা স্পর্শকাতর, তা স্পষ্ট হয়।
৮০ বছর বয়সী খালেদা জিয়া টানা ১১ দিন ধরে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতা ও আর্থ্রাইটিসসহ দীর্ঘদিনের অসুস্থতার ওপর নতুন করে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে গত ২৩ নভেম্বর তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে পরীক্ষা–নিরীক্ষায় দেখা যায় তাঁর হৃদ্যন্ত্র ও ফুসফুসে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।
চিকিৎসকেরা প্রতিদিনই তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণে থাকলেও সামগ্রিক উন্নতি এখনো দৃশ্যমান নয়। বরং তাঁরা বলছেন, আগামী কয়েকটি দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কিডনি কার্যক্ষমতায় স্থিরতা না এলে অন্য অঙ্গের উন্নতি সম্ভব নয়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড নিয়মিত পর্যালোচনা করছে তাঁর চিকিৎসা। লিভারের জটিলতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং ফুসফুসের সংক্রমণ প্রতিরোধে কয়েক দফা মেডিকেল হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ায় যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রিচার্ড বিয়েল বুধবার সকালে ঢাকায় এসে মেডিকেল বোর্ডে যোগ দিয়েছেন। তিনি এর আগেও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় পরামর্শ দিয়ে এসেছেন। তাঁর আগমনকে চিকিৎসার কৌশল নতুনভাবে সাজানোর অংশ বলেই মনে করছেন অনেকে।

চিকিৎসকেরা জানান, জটিল রোগের সমন্বিত চিকিৎসা দিতে আন্তর্জাতিক পরামর্শ জরুরি-বিশেষ করে লিভার ও কিডনি উভয় অঙ্গের ওপর চাপ বাড়লে রোগীর সামগ্রিক শারীরিক স্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়।
প্রধান উপদেষ্টার আগমনের ২৪ ঘণ্টারও কম সময় আগে মঙ্গলবার রাতে খালেদা জিয়ার খোঁজ নিতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন দেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান।
তিন বাহিনীর প্রধানের একসঙ্গে হাসপাতালে যাওয়া এ ধরনের পরিস্থিতিতে সচরাচর দেখা যায় না। তাদের উপস্থিতি শুধু রাজনৈতিক দিক থেকেই নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উদ্বেগও কতটা গভীর সেটি স্পষ্ট করে।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে ভিড় জমাচ্ছেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা। কেউ দাঁড়িয়ে দোয়া করছেন, কেউবা খবর নিতে ব্যাকুল হয়ে একের পর এক ফোন করছেন। এর ফলে হাসপাতালের সামনের সড়কে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সন্ধ্যায় দলীয় নেতা–কর্মীদের উদ্দেশে অনুরোধ জানান, পরিস্থিতি সংবেদনশীল, তাই অনাকাঙ্ক্ষিত ভিড় ও চাপ সৃষ্টি না করে দূর থেকে দোয়া করতে। তাঁর মতে, হাসপাতালের ভেতরে চিকিৎসা চলছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে ভিড়ের চাপ কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।
খালেদা জিয়ার শরীরের জটিলতা ও চিকিৎসা নিয়ে শুধু বিএনপি নয়, দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনেই চলছে নানা আলোচনা। প্রধান উপদেষ্টা ও তিন বাহিনী প্রধানের আগমনকে অনেকেই ব্যাখ্যা করছেন রাষ্ট্রীয় মানবিক দায়িত্ব হিসেবে। অন্যদিকে দেশের বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান নেত্রীর দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কী প্রভাব ফেলতে পারে এ নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ।
অনেকেই মনে করছেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি চেয়ারপারসনের সুস্থতা শুধু দলীয় স্বার্থ নয়, সামগ্রিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে চিকিৎসকেরা সতর্ক রোগের জটিলতা এবং বয়স দু’টিই চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলছে।
দীর্ঘদিনের বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা, তার ওপর নতুন সংক্রমণে খালেদা জিয়ার অবস্থা এখনও সংকটাপন্ন। প্রধানমন্ত্রী নয়, রাষ্ট্রপ্রধানও নন তবু দেশজুড়ে একজন রাজনীতিকের শারীরিক অবস্থাকে ঘিরে এমন উদ্বেগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। আগামী কয়েকটি দিন তাঁর চিকিৎসা ও শারীরিক স্থিতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসকেরা তাই বলছেন।
দেশের শীর্ষ নেতারা হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়ে সংবাদ নেওয়ায় বোঝা যাচ্ছে, ঘটনাপ্রবাহ এখন মানবিক উদ্বেগের সীমা ছাড়িয়ে আরও বড় পরিসরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
Leave a Reply