
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:: মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের একটি হাসপাতালে বিমান হামলা চালিয়েছে। হামলায় অন্তত ৩৩ জন নিহত হয়েছে। তবে সেনাবাহিনীর দাবি, নিহতরা সবাই বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য ও তাদের সমর্থক-বেসামরিক নাগরিক নয়। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী, ত্রাণকর্মী, বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং জাতিসংঘ জানিয়েছে, হাসপাতালে নিহতরা বেসামরিক মানুষ ছিলেন।
শনিবার রাষ্ট্রীয় দৈনিক গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সামরিক বাহিনীর তথ্য দফতর জানায়, জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্সসহ একাধিক গোষ্ঠী ওই হাসপাতালটিকে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছিল।
বিবৃতিতে বলা হয়, বুধবার সেনাবাহিনী প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং ম্রাউক-উ টাউনশিপের ওই সাধারণ হাসপাতালের বিরুদ্ধে একটি সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে।
তবে জাতিসংঘ বৃহস্পতিবার জরুরি চিকিৎসা, প্রসূতি সেবা ও অস্ত্রোপচার সুবিধা প্রদানকারী ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। সংস্থাটি বলেছে, এটি দেশজুড়ে বেসামরিক মানুষ ও বেসামরিক স্থাপনায় ক্ষতি সাধনকারী হামলার একটি বিস্তৃত ধারার অংশ, যা বহু সম্প্রদায়কে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক হামলাগুলোর সবচেয়ে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানান এবং তদন্তের দাবি করেন। তিনি এক্সে লেখেন, ‘এই ধরনের হামলা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। আমি তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছি এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানাই। এখনই এই লড়াই বন্ধ করতে হবে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেয়েসুস বলেন, তিনি ‘স্তম্ভিত’। এক্সে দেওয়া পোস্টে তিনি লেখেন, ‘কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত হয়েছেন—যাদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন। হাসপাতালের অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; অপারেশন থিয়েটার এবং প্রধান ভর্তি ওয়ার্ড সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।’
দেশটির সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গুন থেকে ৫৩০ কিলোমিটার (৩২৬ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ম্রাউক-উ শহরটি ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরাকান আর্মি দখল করে নেয়।
আরাকান আর্মি হলো রাখাইন জাতিগত সংখ্যালঘু আন্দোলনের সুপ্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সামরিক শাখা, যারা মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন চায়। তারা ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে রাখাইনে আক্রমণ শুরু করে এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি আঞ্চলিক সেনা সদর দফতরসহ রাখাইনের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৪টির নিয়ন্ত্রণ নেয়।
রাখাইন আগে আরাকান নামে পরিচিত ছিল। ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর এক নির্মম দমন-পীড়নমূলক অভিযানের কেন্দ্রস্থল ছিল এটি। ওই অভিযানে মুসলিম-অধ্যুষিত প্রায় ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে বৌদ্ধ রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখনও জাতিগত উত্তেজনা বিরাজ করছে।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে আরাকান আর্মি জানায়, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তারা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় এই বিমান হামলার দায় নির্ধারণে কাজ করবে এবং সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর ও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেবে।
সামরিক সরকার ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনের আগে বিমান হামলা জোরদার করেছে। সামরিক শাসনের বিরোধীরা অভিযোগ করছে, এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না; বরং এটি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ধরে রাখাকে বৈধতা দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা মাত্র।
২০২১ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মিয়ানমার অস্থিরতায় রয়েছে, যার ফলে ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি হয়। সামরিক শাসনের বহু বিরোধী পরে অস্ত্র হাতে নিয়েছে, আর দেশটির বড় একটি অংশ এখন সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে।
Leave a Reply