
নিজস্ব প্রতিবেদক:: মৃদু হাওয়া নয় এ যেন হাড় কাঁপানো এক শীতল স্পর্শ। ভোরের আলো ফোটার আগেই কুয়াশার ঘন চাদরে ঢেকে যাচ্ছে শহর-গ্রাম, মাঠ-ঘাট, সড়ক-মহাসড়ক। কনকনে শীত আর কুয়াশার দাপটে দেশজুড়ে যেন এক অদৃশ্য স্থবিরতা নেমে এসেছে। শীতের এই আকস্মিক ও তীব্র আগমনে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর, রিকশাচালক, খেটে খাওয়া মানুষ আর সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো।
গত কয়েক দিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা হঠাৎ করেই অনেকটা নেমে গেছে। উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণাঞ্চল প্রায় সব জেলাতেই শীতের প্রকোপ বেড়েছে। রাতের দিকে হাড় জিরজিরে ঠান্ডা আর ভোরের দিকে ঘন কুয়াশা জনজীবনকে চরমভাবে ব্যাহত করছে। সূর্যের দেখা মিলছে দেরিতে, আবার অনেক সময় সারাদিনই সূর্য ঢেকে থাকছে কুয়াশার আড়ালে।
শীত মানেই আরাম এই ধারণা শুধুই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল মানুষের জন্য। যারা প্রতিদিন কাজ না করলে সন্ধ্যায় চুলায় হাঁড়ি ওঠে না, তাদের কাছে শীত এক কঠিন বাস্তবতার নাম। নির্মাণ শ্রমিক, কৃষিশ্রমিক, ইটভাটার কর্মী, ফেরিওয়ালা কিংবা দিনমজুরদের অনেকেই কনকনে শীতে কাজে যেতে পারছেন না।
ভোরের ঠান্ডায় শরীর সাড়া দেয় না, হাত-পা অবশ হয়ে আসে। কাজের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে স্থবিরতা। নির্মাণকাজে গতি কমেছে, মাঠে নামছে না শ্রমিক, ফলে আয়ের পথ সংকুচিত হচ্ছে। অনেক দিনমজুর জানান, কাজের সুযোগ থাকলেও শীতের কারণে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ছে, ফলে বাধ্য হয়ে কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
শীতের কাঁপুনিতে সবচেয়ে দৃশ্যমান কষ্টে আছেন রিকশাচালকরা। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচে থাকা এই মানুষগুলো শীতের তীব্রতায় কার্যত অসহায়। মোটা জামা, গ্লাভস কিংবা কানঢাকা টুপি এসব অনেকের পক্ষেই কেনা সম্ভব নয়।
ঘন কুয়াশার কারণে রাস্তায় যাত্রীও কমে গেছে। অনেকেই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। ফলে রিকশাচালকদের আয় কমছে অর্ধেকে নেমে আসছে। একই চিত্র বাস, ট্রাক ও অন্যান্য পরিবহন শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও। কুয়াশায় দৃষ্টিসীমা কমে যাওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে, অনেক রুটে যান চলাচল সীমিত করা হচ্ছে।
শীতের কষ্ট শুধু দরিদ্র মানুষের নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণিও পড়েছে ভিন্ন রকম চাপে। শিশুদের স্কুলে পাঠানো, বয়স্ক বাবা-মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষা, বাড়তি শীতবস্ত্র কেনা—সব মিলিয়ে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সীমিত আয়ের পরিবারে এই অতিরিক্ত ব্যয় সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
অনেক পরিবারে পুরোনো শীতবস্ত্রই ভরসা। গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় মাসের শেষে বিল নিয়েও তৈরি হচ্ছে দুশ্চিন্তা। শীতের কারণে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে সর্দি, কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগের প্রকোপ বাড়ছে, যা স্বাস্থ্যখাতে নতুন চাপ তৈরি করছে।
শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে শীতের প্রকোপ অনেক বেশি অনুভূত হচ্ছে। খোলা মাঠ, নদী আর বিলঘেরা এলাকায় কুয়াশা জমে থাকে দীর্ঘ সময়। অনেক গ্রামে সকালে স্কুলে যেতে পারছে না শিশুরা। কৃষিকাজেও প্রভাব পড়ছে শাকসবজি তোলার কাজ বিলম্বিত হচ্ছে, ফসল মাঠেই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে শীতজনিত অসুস্থতা বাড়ছে। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র ও চিকিৎসাসেবার অভাবে অনেকেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
ঘন কুয়াশার কারণে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। অনেক এলাকায় সকালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন আটকে থাকছে। নদীপথেও নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। ফেরিঘাটে দীর্ঘ অপেক্ষা, ট্রেনের সময়সূচিতে বিলম্ব সব মিলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা।
এই পরিস্থিতি ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পণ্য পরিবহনে দেরি হওয়ায় বাজারে সরবরাহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামে।
শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতবস্ত্রের চাহিদাও বেড়েছে। ফুটপাতে, হাটে-বাজারে কম দামের কম্বল ও সোয়েটারের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে দরিদ্র মানুষের জন্য তা এখনও পর্যাপ্ত নয়। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু হলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে সরকার ও সমাজের সব স্তরের মানুষের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, শীতবস্ত্র ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আবহাওয়া সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সামনে আরও কয়েক দিন শীতের তীব্রতা বজায় থাকতে পারে। উত্তরাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। রাতের তাপমাত্রা আরও কমতে পারে, কুয়াশা ঘন হতে পারে ভোর পর্যন্ত।
কনকনে শীতে , মানুষ কাঁপছে তবুও জীবন থেমে নেই। প্রতিকূলতার মাঝেও খেটে খাওয়া মানুষ প্রতিদিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। শীতের বিরুদ্ধে এই লড়াই শুধু প্রকৃতির সঙ্গে নয়, অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গেও।
এই শীত শুধু ঠান্ডা নয় এ এক বাস্তবতার আয়না, যেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সমাজের বৈষম্য, দুর্বলতার জায়গা আর মানবিকতার প্রয়োজন। কুয়াশা কেটে সূর্য উঠবে এই প্রত্যাশায় কাঁপতে কাঁপতেই দিন গুনছে বাংলার মানুষ।
Leave a Reply