বিশেষ প্রতিবেদক:: ২০ থেকে ২৭ অক্টোবর ধারাবাহিক সমাবেশে
রাজপথে ইসলামপন্থী জোট
জুলাই সনদে নতুন বিতর্ক
জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিসসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ৫ দফা দাবি বাস্তবায়নে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
রোববার এ কর্মসূচি ঘোষণা করে দলগুলো।
কর্মসূচির আওতায় ২০ অক্টোবর রাজধানীতে, ২৫ অক্টোবর বিভাগীয় শহরে এবং ২৭ অক্টোবর জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ ঘোষণা করেছে দলগুলো। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, গণভোট, পিআর পদ্ধতিসহ ৫ দফা দাবি বাস্তবায়নে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।
তাদের দাবি, জুলাই সনদ বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর আইনি বৈধতা, জনগণের অংশগ্রহণে গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন এবং অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে নির্বাচনী সংস্কার নিশ্চিত করা।
এই পাঁচ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের আভাস মিলছে। বিশেষ করে জুলাই সনদকে ঘিরে এতদিন যে বিতর্ক ছিল, ইসলামপন্থী জোটের নতুন অবস্থান সেটিকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে।
গত জুলাইয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই সনদ নামে যে সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিল, তা রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছিল।
প্রায় সব রাজনৈতিক দলই শেষ পর্যন্ত সনদে স্বাক্ষর করলেও তারা বলেছিল, সংবিধান পরিবর্তন বা রাষ্ট্র কাঠামো সংশোধনের মতো বিষয়ে জনগণের মতামত ছাড়া কোনো সনদ টেকসই হতে পারে না।
এবার তারা রাজপথে নেমে সেই দাবিকেই নতুন করে তুলছে জুলাই সনদের গণভোট চাই।
জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস ও সংশ্লিষ্ট দলগুলো তাদের ঘোষণায় ৫ দফা দাবি উপস্থাপন করেছে। দাবিগুলো হলো, জুলাই সনদের আইনি বৈধতা, গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ অনুমোদন, পিআর পদ্ধতির প্রবর্তন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের পূর্ণ সাংবিধানিক গ্যারান্টি, রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামি মূল্যবোধ ও নৈতিক নীতিমালা পুনঃস্থাপন।
এই দাবিগুলোর ভাষা যতই রাজনৈতিক শোনাক, বাস্তবে এটি দেশের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরির ইঙ্গিত। একদিকে সংস্কারপন্থী দলগুলো, অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি।
২০ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুতি নিয়েছে। ঢাকায় আয়োজিত ওই সমাবেশে অন্তত দেড় লাখেরও বেশি নেতাকর্মী অংশ নেবে বলে আয়োজকরা দাবি করছেন।
এরপর ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেটসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে কর্মসূচি হবে। ২৭ অক্টোবর জেলা পর্যায়ে ‘সনদ বিরোধী সমাবেশ’ আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।
সরকার বিষয়টিকে প্রথমে তেমন গুরুত্ব না দিলেও, এখন বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেছেন, জুলাই সনদ নিয়ে যেকোনো মতভেদ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতরেই সমাধান করা উচিত। রাজপথের অস্থিতিশীলতা কেউ চায় না।
তবে গোপনে সরকারের কিছু অংশে আশঙ্কা জামায়াত ও খেলাফত মজলিসের এই সমাবেশের পেছনে বৃহত্তর বিরোধী জোটের সমর্থন থাকতে পারে।
অন্যদিকে ইসলামপন্থী নেতারা বলছেন, আমরা সংঘাত চাই না, গণভোট চাই। সরকার যদি আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে জনগণের মতামতের সামনে কেন ভয়?
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, এটি কেবল সনদ বিরোধিতা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক পুনঃসংগঠনের প্রচেষ্টা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রওনক জাহান বলেন, এই মুহূর্তে গণভোটের দাবি বাস্তবসম্মত নয়, তবে এটি সরকারের নৈতিক দায়বোধের প্রশ্ন তুলছে। জুলাই সনদ যদি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়, জনগণের অংশগ্রহণ কেন থাকবে না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. নাজমুল হাসান বলেন, ইসলামপন্থী দলগুলো তাদের সামাজিক ভিত্তি কাজে লাগিয়ে আবারও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরতে চাইছে। এটা রাজনৈতিক শক্তির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
জুলাই সনদ মূলত নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রশাসনিক সংস্কার ও সংসদের কাঠামো পুনর্গঠনের রূপরেখা। কিন্তু এতে জনগণের প্রত্যক্ষ মতামত অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় সেটি ‘উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া’ মনে করছে অনেক দল।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণভোট সংবিধানের ধারা ১৪২ অনুযায়ী সম্ভব, তবে সেটি রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া করা যাবে না।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, জুলাই সনদে অর্থনৈতিক ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার দিকটি ভালোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো তা কতটা আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করবে।
২০ থেকে ২৭ অক্টোবরের এই ধারাবাহিক সমাবেশের ঘোষণাকে অনেকেই দেখছেন রাজনীতির নতুন মেরুকরণের সূচনা হিসেবে।
একদিকে ইসলামপন্থী জোটের রাজপথে প্রত্যাবর্তন, অন্যদিকে সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টা এ দুটি প্রবাহ রাজনীতিকে নতুন দ্বন্দ্বে ঠেলে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহবুবুর রশীদ বলেন, ২০০৬ সালের মতো রাজনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইসলামপন্থী দলগুলো যদি জনমত সংগঠিত করতে পারে, তাহলে জুলাই সনদ নিয়ে গণভোটের চাপ বাড়বে।
সাধারণ জনগণের কাছে বিষয়টি এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। অনেকে বলছেন, সনদ মানে কি নতুন সংবিধান?
অন্যদিকে গণভোটের কথা শুনে অনেকের মনে পড়ছে ১৯৯১ সালের গণভোট, যা দেশে সংসদীয় পদ্ধতির পথ খুলে দিয়েছিল।
একজন সাবেক শিক্ষক বলেন, আমরা উন্নয়ন চাই, কিন্তু তা যেন জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া না হয়। যদি গণভোট হয়, তাতে ক্ষতি কী?
জুলাই সনদ নিয়ে যে রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হয়েছিল, সেটি ইসলামপন্থী জোটের এই নতুন কর্মসূচিতে আরও তীব্র হয়ে উঠবে। ২০ থেকে ২৭ অক্টোবরের এই ধারাবাহিক সমাবেশ কেবল একটি দাবির আন্দোলন নয়, বরং রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
জামায়াত–খেলাফত মজলিসের পাঁচ দফা দাবি রাজনীতিতে গণভোটের নতুন ভাষ্য তৈরি করেছে, যা সরকার ও সংস্কারপন্থী দলগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও প্রবেশ করছে এক অচেনা পর্বে যেখানে রাজপথ ও গণমত দুটোই নির্ধারণ করবে জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ।
Leave a Reply