
বিশেষ প্রতিবেদক:: রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার জন্য একটি গভীর উদ্বেগজনক অধ্যায় হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার। তিনি বলেছেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন হলে গণতন্ত্রও হুমকির মুখে পড়ে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলা সে রকমই একটি ভয়াবহ বার্তা বহন করে।
রোববার দুপুরে সহমর্মিতা জানাতে প্রথম আলো কার্যালয় পরিদর্শনে এসে এসব কথা বলেন ইইউ রাষ্ট্রদূত। এ সময় তিনি হামলা ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ঘুরে দেখেন এবং ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পর্যবেক্ষণ করেন। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সংঘটিত এই ঘটনায় প্রথম আলো কার্যালয়ের একটি বড় অংশ ভস্মীভূত হয়, লুটপাটেরও অভিযোগ ওঠে।
মাইকেল মিলার বলেন, সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা মানেই কেবল একটি প্রতিষ্ঠানকে আঘাত করা নয়, এটি জনগণের জানার অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি ভয়াবহ মুহূর্ত ছিল। তিনি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না দেখতে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
পরিদর্শনকালে রাষ্ট্রদূত প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং হামলার সময় ও পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নেন। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা, ঘটনার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থার অবস্থা এবং তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কেও তিনি জানতে চান।
নির্বাচনের প্রাক্কালে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তখন মুক্ত ও স্বাধীন সংবাদ পরিবেশ বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে হলে গণমাধ্যমকে নির্ভয়ে কাজ করতে দিতে হবে। ঔতিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হলে তা শুধু সাংবাদিকদের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখা এবং সংবাদ পরিবেশনে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি না হওয়া গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত। একই সঙ্গে তিনি সবার জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। গণতন্ত্র টিকে থাকে জবাবদিহির মাধ্যমে, আর সেই জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের বিকল্প নেই, যোগ করেন তিনি।
ইইউ রাষ্ট্রদূতের এই পরিদর্শনকে গণমাধ্যমের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংহতির একটি স্পষ্ট বার্তা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথম আলোর কর্মকর্তারা জানান, এমন সংকটের মুহূর্তে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কূটনৈতিক সমর্থন তাদের মনোবল জুগিয়েছে।
এ সময় ইইউ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক, উপসম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি এবং অনলাইন বিভাগের প্রধান শওকত হোসেন। তাঁরা রাষ্ট্রদূতকে ঘটনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন এবং হামলার ফলে সংবাদ কার্যক্রমে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করেন।
প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিক ইউনিয়ন ও রাজনৈতিক মহল এই হামলাকে মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর আঘাত হিসেবে অভিহিত করেছে। অনেকেই দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের হামলা শুধু একটি সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ্য করে নয়, বরং সমাজে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে সমালোচনামূলক কণ্ঠ স্তব্ধ করার একটি প্রচেষ্টা। ফলে রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য এটি একটি বড় পরীক্ষা কীভাবে তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে।
ইইউ রাষ্ট্রদূতের ভাষায়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ হোক, যেখানে সাংবাদিকেরা নিরাপদে, স্বাধীনভাবে এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তাঁদের কাজ করতে পারবেন।
এই প্রেক্ষাপটে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনা শুধু একটি দিনের সংবাদ নয়; বরং এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
Leave a Reply