
নিজস্ব প্রতিবেদক:: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা শনিবার সকালে পরিণত হয় এক নীরব কিন্তু গভীর রাজনৈতিক বার্তার সাক্ষীস্থলে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শহীদ শরিফ ওসমান হাদির কবর জিয়ারতের মাধ্যমে তার দেশে ফেরার পর কর্মসূচির এক নতুন অধ্যায় শুরু করেন।
একই সঙ্গে তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিতেও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এই দুই কবর জিয়ারত রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি প্রতীকি অর্থেও তা গভীর ইঙ্গিত বহন করে।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার কিছু আগে তারেক রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশেই অবস্থিত শহীদ ওসমান হাদির কবর। সেখানে পৌঁছে তিনি প্রথমে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং পরে মোনাজাতে অংশ নেন।
মোনাজাত পরিচালনা করেন শহীদ হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। পরিবেশ ছিল সংযত, নীরব এবং আবেগঘন।
ওসমান হাদি ছিলেন সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনের একটি পরিচিত মুখ। তাঁর মৃত্যু রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে এবং তাকে ঘিরে নানা প্রশ্ন ও প্রতিবাদের সূত্রপাত ঘটে। এমন এক ব্যক্তির কবরে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা দেখছেন আন্দোলন-নির্ভর রাজনীতির প্রতি তারেক রহমানের স্পষ্ট অবস্থান হিসেবে। এটি শুধু একটি সৌজন্যমূলক কবর জিয়ারত নয়; বরং এটি একটি বার্তা দলীয় রাজনীতি ও জনআন্দোলনের মধ্যে দূরত্ব কমানোর প্রয়াস।
ওসমান হাদির কবর জিয়ারত শেষে তারেক রহমান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিতে যান। সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং মোনাজাতে অংশ নেন। নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী চেতনা, সাম্য ও মানবিকতার দর্শন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক চিরন্তন অনুপ্রেরণা। বিএনপির শীর্ষ নেতার এই শ্রদ্ধা নিবেদনকে অনেকেই দেখছেন গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীকী স্মরণ হিসেবে।
এই কর্মসূচিতে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্টজনেরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রাজনৈতিক দল ও একাডেমিক অঙ্গনের প্রতিনিধিদের একত্র উপস্থিতি এই ঘটনাকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল জোরদার। শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের মোতায়েন দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, গত দুই দিনের মতো লাল-সবুজ রঙে সাজানো বাসে নয়, আজ তারেক রহমান একটি সাদা রঙের গাড়িতে কবর জিয়ারতে যান। গাড়িটি ফুল দিয়ে সাজানো ছিল। এই পরিবর্তন অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি হয়তো শোক ও শ্রদ্ধার কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত। গাড়ির দুপাশে রাস্তার ধার ধরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সারিবদ্ধ উপস্থিতি দেখা যায়, তবে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করা যায়নি।
এদিকে বিএনপির মিডিয়া সেল সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আহত কেউ হাসপাতালে ভর্তি না থাকায় তারেক রহমান পঙ্গু হাসপাতালে যাবেন না। বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হলেও এটি নিয়েও রাজনৈতিক মহলে আলোচনা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, ভবিষ্যতে তিনি আহতদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করবেন এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
কবর জিয়ারত শেষে তারেক রহমান আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে যান জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধনের জন্য। দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরে নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত এই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করাকে অনেকেই দেখছেন একটি প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে। এটি যেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি নাগরিক জীবনেরও পুনঃপ্রবেশ।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফেরেন তারেক রহমান। তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘিরে ঢাকায় দেখা যায় অভূতপূর্ব জনসমাগম। লাখ লাখ নেতা-কর্মী, সমর্থক এবং সাধারণ মানুষ তাঁকে স্বাগত জানাতে রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকার পূর্বাচলের ৩০০ ফিট এলাকায় অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা সমাবেশে সারা দেশ থেকে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীরা অংশ নেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকা থেকে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন। কর্মসূচি শেষে তাঁরা আবার নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমানের সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলো ধারাবাহিকভাবে একটি বার্তা দিচ্ছে তিনি কেবল দলীয় নেতৃত্বে সক্রিয় হচ্ছেন না, বরং গণমানুষের আবেগ, ইতিহাস ও আন্দোলনের স্মৃতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে চাইছেন। ওসমান হাদির কবর জিয়ারত থেকে শুরু করে নজরুলের সমাধিতে শ্রদ্ধা, এনআইডি নিবন্ধন সব মিলিয়ে এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক পুনঃপ্রবেশের ইঙ্গিত বহন করে।
সব মিলিয়ে শনিবারের এই কর্মসূচি রাজনীতির কোলাহলহীন এক দৃশ্যপট তৈরি করলেও এর অন্তর্নিহিত বার্তা ছিল গভীর। শোক, শ্রদ্ধা ও প্রতীকের মধ্য দিয়ে তারেক রহমান যেন জানিয়ে দিলেন আগামী দিনের রাজনীতিতে স্মৃতি, আত্মত্যাগ ও ইতিহাসের ভূমিকা তিনি অবহেলা করতে চান না।
Leave a Reply